নিউইয়র্ক     শনিবার, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ কামরুল

জিপসি জার্নাল : কবিতায়নের কোলাজ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:৩৩ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
জিপসি জার্নাল : কবিতায়নের কোলাজ

সন্ধ্যা হয় হয় বেলায় ভোলা বাজার লঞ্চঘাটে ভিড়ল এমএল ভোলা-৩। কোনভাবেই ওটাকে লঞ্চঘাট বলা যায় না। সেখানে খালপারাপারের একটা কাঠের পুল ছিল, পায়ে পায়ে রংচটা পুল। তার হাতলে হাতে রেখে, তার উপর উড়িয়ে পা বেশ কিছু খালিগাকিশোর কুলি লাফ মেরে লঞ্চের রেলিঙ টপকে কেবিনের সামনে হুড়মুড় করে পড়ছিল। তাদের চোখে ছিল অনেক অপেক্ষার পরকিছু পাওয়া না পাওয়ার দ্বিধা জড়ানো চোখ। তারা উল্লাসে চিৎকার করে বলছিল, লছ আইয়ে ন, হেলিফপ্টার আইয়ে। ওটাইছিল আমার ভোলা আর্কিপিলাগোয় শোনা প্রথম ডায়ালেক্ট।

কিশোর কুলিরা চটজলদি চকিত হাতে যাত্রীদের লাগেজ মাথায় তুলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকল। পড়ে যায় যায় ভাব তবু পায়েতাদের দুপয়সা আয়ের আনন্দ ছন্দ। চোখের পলকে ওদের ছন্দ পতন হলো। বাজুতে বাঁধা সরকারি অঙ্গদ ব্যান্ড তাগড়া কুলিরাকিশোর কুলিদের মাথা থেকে কেড়ে নিল মাল সামানা। আইনি বাজুবন্দ কেড়ে নিল বেআইনি মাথার বোঝা। বাবা বললো, এরাআইনের কুলি বোঝা ওরাই নেবে। বুঝলাম, আইন যাত্রীদের নিরাপত্তার মালিক। সারা জীবন আর কোথাও দেখলাম না আইনদেশের নিরাপত্তার মালিক।

লঞ্চ থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে রিক্সায় উঠলাম। তখন সন্ধ্যা নামছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার উপশহর ভোলাকে ডুবিয়ে দিচ্ছিলআঁধারে।ভোলায় তখন বিদ্যুৎ বাতি ছিল না; সন্ধ্যা না হতেই তমাল অন্ধকারে ডুবে যেত আদিগন্ত ভোলার দ্বীপভূগোল। লঞ্চঘাটে রিক্সা স্ট্যান্ডের পাশে খোলা আকাশের নিচে প্লাজার মতো একটা সান্ধ্য মাছের বাজার বসেছিল। বরিশাল থেকে বরফআসেনি তাই মণকে মণ মাছ ফেলে দেবে দরিয়া মেঘনায়। ফেলে দেয়ার আগে যে কটা বেঁচা যায়। জেলে নিকেরিদের টুকরিতেগোল করে সাজানো ছিল রূপোরং ইলিশ। কুপি বাতির পলতে গুলো হাওয়ার দোলায় কালাবদর দরিয়ার ঢেউয়ে ঢেউয়েদোলায়মান এম এল ভোলা-৩ লঞ্চের মতো ওঠানামা করছিল আর তার আলোয় মরা ইলিশের চোখ থেকে ঠিকরে পড়ছিলনীল আলো। যেভাবে সুন্দরবনে হরিণ ঝাঁকের চোখে গাজী রকেটের সার্চলাইট পড়তেই ঠিকরে পড়েছিল রহস্যময় নীলালোবন-নদীর জলে।

আকাশাৎ ও রুৎবার বিরাণ মরুরাতে ল্যান্ড রোভারের হেড লাইটের আলোর বিরুদ্ধে ভেড়া ও দুম্বা পালের অজস্র চোখের নীলআলোর স্রোত, কার্লাইল অ্যান্ড ফ্রিঞ্চ কোম্পানীর সার্চ লাইটের আলো বন্দুকের ঘায়ে সুন্দরবনের বন-নদী জলে হরিণের চোখেরনীলাভ জল আর ভোলার মাছ বাজারে নিকেরির টুকরিতে রূপোরং মরা ইলিশের চোখের নীলতা ঐকবাহী।

ভোলায় যেদিন বরিশাল থেকে সময় মতো বরফ এসে পৌঁছুতো না, হাজার হাজার মাছ খেয়াঘাট নামের একটা জায়গায় বড়দরিয়ার স্রোতে ঢেলে দিত। এখনো যে সব চাষী ধান বুনে ধানের দাম পায় না, তারা কষ্টের অনলে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় স্বপ্নদোলাপাকা ধানের পোয়াতি বিল যেখানে শীষের ডগায় দোল খায় কৃষকের স্বপ্ন। দুধ বিক্রি করে চালডাল কিনতে পারে না যে ডেয়ারিফার্মার, কালো রাজপথে তারা ঢেলে দেয় দুধের তুফান — পুন্জীভূত ক্ষোভের নহর। তাদের বুকে কস্টের প্রতিবাদগুলো হয়েছেশাশ্বতিক।

“কতোদূর এগুলো মানুষ!”

ভোলায় তখন ইটের দালান বলতে কোর্ট-কাছারি, গভট (ওরা গভর্নমেন্ট স্কুলকে গভট স্কুল বলতো) স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল— হাতে গোণা কয়েকটা দালানই ছিল। সবেধন নীলমণি একটা সিনেমা হল ছিল নাম চাঁদমহল। দূর থেকে পথে হলো দেরি, হাসপাতাল সিনেমার গান শোনা যেতো। সেখানে রীয়ার স্টল আর মিডিল স্টলের মাঝখানে একটা ক্লাস ছিল —ইন্টার ক্লাস।সেই টিকেটের দাম ছিল আট আনা। লাইনে দাঁড়িয়ে তারা বলতো, আট আনাইক্কা তিনহান দয়াল। নিউ ইয়র্কের অধুনালুপ্তআট আনার কাগজ এখন সময়ের মতো। আট আনার স্থান ও গুণমান বুঝি চ্যাপ্টা ধরণের কিছু।

ভোলায় বাবার অফিসে ন্যুব্জপিঠ এক পাঙ্খা-পুলার ছিল। সেখানে বারান্দায় কি যেনো একটা ম্যামথ মাছের শিরদাড়া দিয়েবানিয়েছি। বসবাস বেঞ্চি। সেই বেঞ্চিতে বসে লোকটা পাঙ্খা টানতো। তার চোখ দুটোর মণিতারায় মরা জ্যোতি জমেছিল। তারকুঁজো চোখ পাথরভাষায় ক্লান্তির কথা বলতো।

বাবার চোখ দুটো জীবনের শেষ দিনগুলোতে পাথরের মতো নিশ্চল নিস্পন্দ হয়েছিল গ্লুকোমা আক্রান্ত চোখ। বুঝি না, কে দ্যাখেঅন্ত্রভেদী — চক্ষুস্মান না দৃষ্টিহীন চোখ! অন্ধ টাইরেসিয়াস না ২০/২০ চোখ — কোনটার দৃক ক্ষমতা অধিক!

সরকারি কোয়ার্টারে তখন চারটে ফ্যামিলি আমরা। থার্ড ম্যাজিস্ট্রেট এন.এন. ভট্টাচার্যের বড় ছেলে বাবলা যদিও বয়সে আমারচাইতে বছর চারেকের বড় তবু এক ঝটকায় আমার বন্ধু বনে গেল। বনবাদাড়ে ঘুরতাম আর একটা বাঁশঝাড়ের নিচে লুকানোমেঠোপথে কাঁচের গুলিমার্বেল খেলে আমাদের বিকেলটা কাঁটতো। একদিন ধনিয়া গ্রামে আখ ক্ষেতের কাছে যেখানে হেলিপ্যাডছিল তার লাগোয়া একটা পরিখা মতো গর্তে দেখি একটা ইগুয়ানা আরেকটা ইগুয়ানার উপর লেপ্টে আছে।

বাবলা বললো, বুঝিস কি হচ্ছে?

কথাটা বলেই বাবলা হেসে কুটিকুটি।

আমাদের দেখে উপরের ইগুয়ানাটা রাগী চোখে তাকালো কিন্তু নড়ল না। নিচের ইগুয়ানার অপলক চোখে ছিল মৃত ইলিশেররূপালী আলোর মতো পরাস্ত দ্যুতি। বাবলা বললো, চল, এ সময়ে কাউকে ডিসটার্ব করতে নেই।

এর বছর খানেক পর এক অপরাহ্ন বেলায় তল্লাবাঁশের ঝোপের আড়ালে বাবলাকে দেখি প্রতিবেশি বিড়ি কারিগর কাকাদের মেয়ে, ঘটিহাতা ফ্রক ও হাফপ্যান্ট পরা ইলার উপর ইগুয়ানার মতোই লেপ্টে আছে। বাবলা ওর হাত ও পা দিয়ে ইলার ইলাস্টিকেরহাফপ্যান্টটা শোয়া অবস্থায় টেনে খুলে নামিয়ে ফেললো। শ্যামল গাঙুলী ওঁর ‘ফিরোজা’ গল্পে এমনি অলস দুপুরে পালঙ্কে শুয়েথাকা ফিরোজার হাঁটুর ওপরে উঠে যাওয়া শাড়ির খোলা পা দেখে লিখেছিল, ফিরোজার পা জোড়া স্বর্গের সিঁড়ি।

ইলা শুয়েছিল যেনো ঘড়ির কাটায় দশটা বেজে দশ মিনিটের মতো। এই বর্ণনাটা হারুকি মুরাকামির ‘উইন্ড আপ বার্ডসক্রনিকেল’ উপন্যাসের। ইলার চোখে ছিল মৃত ইলিশের মতো নিস্প্রভ আলো। মনে পড়ল বাবলার বাইবেলের একটা সেইcommandment — এ সময় কাউকে ডিসটার্ব করতে নেই! তাই চলে এলাম। শুধু ডিসটার্ব নয়, এ সব নিয়ে কথাও বলতে নেই— এই টাব্যু আমাদের অনেক কালের টাব্যু।

বাংলা সাহিত্যে সেক্স-টাব্যু যেনো শাশ্বতিক। যে রকম পশ্চিমা সাহিত্যে ভিক্টোরিয়ান যুগ পর্যন্ত যৌনতার কথা ছিল পাপ, ভয়ানক-বাক। গোপন কথার ভল্টে তালাবন্ধ তোলা থাক। ভোলা ছিল আমার কাছে বাৎসায়নের চানমারি।

পৃথিবীতে যৌনতার এনসাইক্লোপিডিয়া কামসূত্র শুধু ভারতেই রচিত হয়েছিল। তবু আমরা ভারতীয়রা যৌনতার টাব্যু ঘেরামানুষ। আমাদের কবিতায়, সাহিত্যে, ভ্যাগাবন্ড সাহিত্য অর্থাৎ ট্রাভেলগ সাহিত্যে যৌনতার কথা তোলা ট্যবু। ভিক্টোরিয়ান যুগেযেমন সাহিত্যে যৌনতার কথা বলা ছিল নিষিদ্ধ। সে যুগে মুদ্রিত অক্ষরে যৌনতার কথা বললে তার জেল জরিমানা হতো।আধুনিক সাহিত্যের কালে জীবনানন্দ দাশের চাকরি চলে গিয়েছিল তার কবিতায় যৌনগন্ধী পোয়েটিকস এর জন্য। রোম্যান্টিকযুগের কবি যাকে আধুনিক কবিতার প্রধানতম শ্রষ্ঠা বলা হয়, শার্ল বোদলেয়রের সাজা হয়েছিল সাহিত্যে সামাজিক শ্লীলতারসীমা লঙ্ঘনের অপরাধে। তার ফ্লার দ্যু মাল কাব্যগ্রন্থ থেকে ছয়টা কবিতা নিষিদ্ধ করেছিল সমাজপতিগণ। আহা! সমাজে যেনযৌনতা নেই!

বাস্তবতা হলো, সমাজই সব রকমের সেক্স আছে — নিম্ফোম্যানিয়া, স্যাটরোমেনিয়া, রেপ, জেরান্টোফিলিয়া, পেডোফিলিয়া, ক্রনোফিলিয়া, ইনসেস্ট ইত্যাদি যৌন সম্পর্ক সমাজেই আছে, সমাজেই ঘটে চলেছে। মানবেরা করছে।মহামানবেরা করেছিল। তানিয়ে কথা বললে কেন অপরাধ হবে? ভিক্টোরিয়ান যুগের পরে রেনেসাঁর শুরু থেকে এই টাব্যু ভেঙে পড়তে থাকে। রোম্যান্টিকযুগে সেটা স্পস্ট হয়ে ওঠে। আধুনিক সাহিত্যে সেক্স একটা আলাদা জানরা হয়ে ওঠে। ফিকশন জানরা, নন-ফিকশন জানরা, ক্রসওভার জানরা সাহিত্যে সেক্স এখন অবাধ।

হাসান আজিজুল হকের ‘একটি আত্মরক্ষার কাহিনী’ গল্পে ষাটের দশকের মধ্যভাগে, তারপর, সৈয়দ হকের ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসে যৌনতার গনগনে ন্যারেটিভস াহিক্য পাঠে প্রথম পড়ি। এখন ট্রাভেলগেও যৌনতার রগরগে অনুপ্রবেশ ঘটেছে।তাতে নাকি বাংলাদেশে ভ্রমন সাহিত্যের বাজার হটকেক কাটছে বেস্ট সেলার।ভ্যাগাবন্ড লেখক যৌনগন্ধী ভ্রমণ কাহিনী লিখেপুরস্কারও পাচ্ছে। এখন যৌনতা কথাসাহিত্যের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। জনৈক নারীবাদ লেখক তো কথা সাহিত্যের নামে ফ্যামিলিপ্ল্যানিং দপ্তরের মাঠকর্মীর ঋতুস্রাব নিয়ে লেখা রিপোর্টের মতো সেক্স লিখে সাহিত্য পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছেন। আর্ট ফিল্মে বেডসিনতো অপরিহার্য। বলা হয় কাহিনীর প্রয়োজনে সিনেমা ও গল্প উপন্যাসে যৌনতা আসে। প্রশ্ন, পাঠক ও দর্শকদের বুঁদ বানাতে কিসাহিত্যে ও আর্ট ফিল্মে যৌনতার পশা? চটি লেখার বদলে সেক্স জানরা লেখা। সে যাই হোক না কেন, যৌনতার টাব্যুটা তোভেঙেছে। ভয়ানক শব্দের হাতুড়ি পিটিয়ে ভেঙেছে ট্যাবু পাথর তসলিমা নাসরিন।

সময়টা তখন পয়ষট্টির টালমাটাল সময় যেনো ডাঙায় কালাবদর দরিয়ার দামাল মাতাল ঢেউ উঠেছে। মুসলিম লীগেরহিন্দু-নিধনযজ্ঞ চলছিল সারা দেশ জুড়ে। খবরের কাগজের সংগে আমার রোজকার দেখা শুরু হয় পিছনে অনেক পিছনে ভোলাউপশহরে। সন্ধ্যায় হকার আসতো যখন বাতিঅলা আমাদের কোয়ার্টারের মেইন গেট খুলে বাসি বাতি দুটো বের করে নতুন বাতিঢুকিয়ে দিয়ে যেতো। বায়েজিদ হারিকেনের আলোয় ফর্সা হয়ে উঠতো চারপাশ। দেখতে পেতাম অনেক দূর থেকে একটা ভিন্টেজহাম্বার বাইসাইকেল চেপে হকার আসতো। পিছনের চাকার সাইডওয়ালে ঘসা খেতে থাকতো বটল-ডাইনামো আর কালাবদরনদীর ঢেউয়ে আলতু মিঞার লঞ্চের মতো দুলতে দুলতে ছড়িয়ে আসতো সামনে লাগানো এ্যান্টিক লাইটের আলো।

হকার প্রথমে বেলবাটি বাজাতো ক্রিং ক্রিং ক্রিং। তারপর কিকস্ট্যান্ডে বাইকটাকে এক পায়ে দাঁড়ানো বকের মতো দাঁড় করিয়ে রেখেব্যাক র‍্যাকে রাখা এক গাঁদা কাগজের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে ঠিকঠাক টেনে বের করে আনতো আমাদের কাগজটা। লম্বা পা ফেলেবারান্দায় এসে দরোজার তলা দিয়ে কাগজটা গলিয়ে দিত। আমি কাগজটাকে বন্ধুর মতো দুহাতে তুলে নিতাম বুকে।

সেই সময়টা ছিল দমকা হাওয়ার মতো চারিদিকে হিন্দু বিরোধী দাঙ্গাদিন। কাগজে সেসব খবরগুলো ছাপা হতো না তেমন। বাবাআমাদের মার্ফি রেডিওতে রোজ রাতে বিবিসি শুনতো। রেডিওটা অন করার অনেক্ষণ পর শব্দ আসতো। নবটা ঘুরাতে আমারদু’তিনটে আঙুলের ডগায় কুলাতো না, পুরো করতল ও সবগুলো আঙুল লাগতো। তখন কাগজগুলো বড় একটা গোলাপ ফুলছাপতো আর তাতে বুখারি শরিফের একটা হাদিস লেখা থাকতো যার বাংলা অনুবাদ করেছিল ছন্দের যাদুকর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,

“জোটে যদি মোটে একটি পয়সা

খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি’

দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার

ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!

মুসলিম লীগের পোস্টারেও একটা গোলাপ আর ছড়াটা ছাপা হতো। বড় হয়ে জেনেছিলাম ওটা কোন হাদিস নয়; ওটাসত্যেন্দ্রনাথের ফুলের ফসল নামক মৌলিক কবিতার লাইন। ধর্মকে গ্লোরিফাই করার জন্য ধর্মানুসারীরা অনেক অমোন অলীককথাকেচ্ছা ছড়ায়।

শিশুকাল আমার দুহাতে তুলে দিয়েছিল মার্বেল গুলির মতো কিছু স্পন্দনদিন। তুলে দিয়েছিল ‘মেঘ হুমহুম’ আকাশের মতোএকটানা কারফিউ আক্রান্ত সুনশান শহর। সাইরেনের এফোঁড়-ওফোঁড় শব্দে ট্রেঞ্চের কবরে লুকোনো দিন।পয়ষট্টির মুসলিমলীগের দাঙ্গা আগুনে পাড়ায় পাড়ায় জ্বলেছিল দাউদাউ ইনফার্নো। মধ্যরাতের হুন্ডির হাতে পাল্টে গিয়েছিল ল্যান্ডস্কেপ।হিন্দুরাছেড়ে গিয়েছিল কতো জনমের ভিটেমাটি, উঠোনের তুলশীবেদি।মৌনতার ভিতর উন্মূল মানুষেরা রেখে গিয়েছিল অঢেল কাঁন্নারভাঙা স্বর। সকালে ঘুম থেকে উঠে আর পাইনি দুলাল, সন্ধ্যা, চঞ্চলাদের। শিশু মনে সখ্য হারানোর বেদনা অনপনেয়, কিছুতেইতা মুছে ফেলা যায় না।

ডাঙর হয়ে উঠতেই ভেবেছিলাম যাই, কোলকাতার সবগুলো দরোজার কড়া নেড়ে শুধোই, চঞ্চলাকে চেনেন কেউ, চঞ্চলা মোক্ষদা, তার মাথা বোঝাই উড়তো এন্জেলা ডেভিসের মতো ঝাকড়া তরঙ্গ চুল, খুব সকালে মর্ত্যের পারিজাত, শিউলি কুড়াতো একা।হেয়ার ইনডেক্স এ যাকে বলে ইউলোট্রিচি চুল।

মুসলিম লীগের মৃত্যুর পর কারা স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু নিধন চালিয়ে যাচ্ছে? মুসলিম লীগের মৃত্যুর পর স্বাধীন বাংলাদেশেকারা বাংলাদেশের হিন্দুদের উচ্ছেদ করে চলেছে? হিন্দুদের আমরা সাতচল্লিশ থেকে বাধ্য করেছি শিখতে, বাংলাদেশ তোমাদেরদেশ না; তোমাদের দেশ ভারত। তাই তারা বাড়ি বানায় ভারতে। তাই তারা টাকা পাঠায় ভারতে। এই প্রেমিস থেকে উপসংহারটেনে হিন্দুদের দেশবৈরী ভাবলে তা হবে ফ্যালাসি, তা হবে সার্বিকীকরণের ত্রুটি (faulty generalization)। বাংলাদেশেরমুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ করেছে হিন্দুরা। তারা সংখ্যায় অনেক বেশি। তাদের দেশপ্রেম প্রমাণিত। আমরা তাদের দেশপ্রেমেরউচ্চতার কাছে ছোট হতে চাইনা বলেই তাদের বিরুদ্ধে নিধনজজ্ঞ চালাই অবিরত।

আর কতো ?

আর কতোকাল ?

এবার আসুন ইতিহাসের সার্বিকীকরনের হেত্বাভাস সুধরে নেই। বলি, বাংলাদেশ হিন্দুদের। তাদের জান-মাল-ইজ্জতের হেফাজতকরবো আমরা।সরকার দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপিরা আইনের ছত্রছায়ায় কেড়ে নিচ্ছে হিন্দুদের তাবৎ স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তিযেমন করে লঞ্চ ঘাটে বাজুতে আইনি ব্যাজ লাগানো তাগড়া কুলিরা কিশোর কুলিদের মাথা থেকে কেড়ে নিয়েছিল মালপত্র।

একদিন সন্ধ্যায় পুরো ভোলা উপশহরটা আলোময় হয়ে উঠেছিল। মিছিলের হাতে হাতে বায়েজিদ হারিকেনের আলো ছুটেচলেছিল। ফাতিমা জিন্নাহর নির্বাচনী মার্কা ছিল হারিকেন। গোলাপের বিরুদ্ধে আলো। তার পরে শুরু হলো হিন্দুদের উপরমুসলিম লীগের উচ্ছেদ অত্যাচার। চোখের সামনে হারিয়ে গেল আমার চারপাশের প্রিয় মুখগুলো। মধ্যরাতে পালিয়ে যাওয়াসুন্দর মানুষের জন্য হুহু করেছিল ভোলায় আমার দিনগুলো।

একজন মানুষকে আরেকজন মানুষের অন্তর্লোক, হৃদয় স্পন্দিত ঘটনা, প্রিয় জনপদ কবি বানিয়ে যায়। মেঘনার ইলিশা ঘাটেজেটির পাটাতনে বসে এক কিশোরী মেঘজ জলের ধারায় পা দোলাতো, তার পায়ের দোলায় দুলে উঠতো বেগানা জলের হাত, বাজতো বুকে জলের এস্রাজ, জলতরঙ্গের অর্কেস্ট্রা। সেই ছবি-সঙ্গীতে ছিল কবিতার তুলি ও লিরিক।তার জন্য লিখতেপেরেছিলাম এই কবিতাখানি,

“বিকেলে জেটির জলে ডুবিয়ে পা যে গিরিকিশোরী

পায়ের নুপুরে ও মলে বাজিয়ে জলের অর্কেস্ট্রা

অবশ করতো নদীমন, তাকে খুঁজি।

রূপমূর্তি ভাঙি আর গড়ি

অদ্ভূত ইমেজারি !

আহাজারিও বটে !

নদীকিশোরীর ছবিটা ছোটায় প্রগত স্রোতের বাঁকে।

পাথরে উপলে ভাঙে জোয়ার ছলাৎছল

পায়ের জোয়ারে কীর্তনখোলার ঢেউ টেনেছিল খুব

টালমাটাল ঘূর্ণিজলে দিতে পরাবাস্তব ডুব।

দূর বটগাছে ভিনদেশি সবুজ লাজুক হরিয়াল

লাল বটফলের হৃৎমাংস ঠুকরে খেতো

চিমনির ধোঁয়ার পিছনে সীগালের মতো উড়ে যেতো অনির্দেশ!

ও হরিয়াল,

ও সবুজ লাজুক পাখির ডানা, বল,

উড়েছে সে গিরিকিশোরী কোন্ দ্রাঘিমায়

কতোটা আকাশদূর নীলতায়!

পাইনি টের কখন গ্যাছে খেয়ে একখানা সবুজ হৃদয়!”

কবিতাটি আমি উৎসর্গ করেছি ঢাকার মশহুর ফ্যাশান ডিজাইনার রত্না গুলজারকে। কবিতার ছবি, চিত্রকল্প, মেটাফর আমিপেয়েছিলাম সুদর্শনা রত্নার কাছ থেকে।

ভোলায় তখন বিদ্যুৎ বাতি ছিল না। আলোকিত করতে পারত না আদিগন্ত। কিন্তু ভোলা আমার অন্তর্লোকে কবিতার আলোজ্বেলে দিয়েছিল। জ্বেলে দিয়েছিল প্রতিবাদের আগুন। মগজে কবিতা এখন খরাক্রান্ত মাঠের মতো। হে গিরিকিশোরী, একবার চলো যাই মেঘনার ইলিশা ঘাটে। জেটিতে বসে বেগানা জলে দোলাবে পা, স্বর্গের সিঁড়ি। আমি লিখবোএকটি নতুন কবিতা, যেমন এলিয়ট লিখেছিল, “breeding lilac out of the dead land”…(“ব্রীডিং লাইলাক আউট অব দ্য ডেড ল্যান্ড” না হয় “একটি নিমেষ দাঁড়ালসরণী জুড়ে/ থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি/ একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা/ প্রলয়েরে পথ ছেড়ে দিল অকাতরে”। নিউ ইয়র্ক, এপ্রিল ২০২৩

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন