নিউইয়র্ক     বুধবার, ৪ঠা অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ  | ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সাক্ষাৎকার: সুলতানা কামাল

গুম-নিখোঁজ তদন্তে পৃথক সংস্থা জরুরি

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২২ | ১১:১২ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২২ | ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
গুম-নিখোঁজ তদন্তে পৃথক সংস্থা জরুরি

বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী সুলতানা কামাল। বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে ভার্চুয়ালি সমকালকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কথা বলেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ রনি।
সমকাল : ভারতের একটি পত্রিকায় আপনাকে উদ্ধৃত করে প্রকাশিত একটি বক্তব্য নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে। এ ব্যাপারে আপনি এরই মধ্যে জানিয়েছেন, আপনার বক্তব্য খণ্ডিত ও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃত বিষয়টি কী? আপনি কী বলতে চেয়েছেন?

সুলতানা কামাল : ভারতের পত্রিকাটির সাংবাদিক কয়েক বছর আগে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ‘সরি খালেদা’ শীর্ষক একটি সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই ভাষায় আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, বিএনপির মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে মিথ্যাচার করার ইতিহাস আছে, আমি সেই খবর সম্পর্কে অবহিত আছি কিনা এবং এর বিরুদ্ধে কী করণীয় আছে বলে মনে করি। ওই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম যে, যেখানে প্রযোজ্য সেখানে এর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রশ্নটি উল্লেখ না করেই তাদের কিছু কথা আমার বলে এবং আমার কথাও অসম্পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গ মানবাধিকার-সংক্রান্ত তালিকা বা মানবাধিকার-সংক্রান্ত সমসাময়িক অভিযোগের বিষয় সম্পর্কিত ছিল না।

সমকাল : গুম বা নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি তালিকা নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে আলোচনা হচ্ছে, এক পক্ষ অভিযোগ করছে গুম ও নিখোঁজের সঙ্গে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত রয়েছে। অন্যদিকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলে আসছেন, অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আপনি কী মনে করেন? অভিযোগের বিষয়ে সরকারের করণীয় কী হতে পারে?

সুলতানা কামাল : দীর্ঘদিন ধরেই যাঁদের পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই নির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করেছেন যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাঁদের তুলে নেওয়া হয়েছে। অপর পক্ষে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা অস্বীকার করে আসছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হচ্ছে, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এসব অভিযোগের সত্য উদ্ঘাটন করা। কেননা, সাংবিধানিকভাবে এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এটা তাদেরই দায়িত্ব। প্রথম থেকেই সে দাবিই জানিয়ে আসছেন ভুক্তভোগী পরিবার ও মানবাধিকারকর্মীরা।

সমকাল : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে নিখোঁজ ও গুমের মতো ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য সরকারকে পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন, এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

সুলতানা কামাল : এটা অবশ্যই একটি কার্যকর পন্থা হতে পারে। আইন অনুযায়ী যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত সেই বাহিনীর সদস্যরা করে থাকেন, সেখানে সেই তদন্তের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন থাকার অবকাশ রয়েছে। পৃথক তদন্ত সংস্থা হলে ফলাফল অধিক বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার আশা করা যায়।
সমকাল : একটা সময় দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ার প্রকট আকার ধারণ করেছিল, এটি সাম্প্রতিককালে অনেকটা বন্ধ রয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণ কী বলে মনে করেন?

সুলতানা কামাল : পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হতে পারে জাতীয়, আন্তর্জাতিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজ এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে নিরলসভাবে সোচ্চার থেকেছে। তবে আমাদের বক্তব্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা প্রকট আকার থেকে কমে এলেও বন্ধ হয়নি। আমাদের কাছে এটা নীতির প্রশ্ন, শুধু সংখ্যার নয়। একটা সভ্য দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারে না।

সমকাল : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। দেশের কিছু এলাকায় সরকার সমর্থক আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি জোট সমর্থকদের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে কিনা?

সুলতানা কামাল : অবশ্যই ফেলবে। জনগণ চায় নিরাপদে, শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে। সেটা বিঘ্নিত হতে পারে- এমন যে কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হোক জনগণের কাছে তা বাঞ্ছনীয় নয়।

সমকাল : বিএনপিসহ কয়েকটি দল উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে- এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? বিকল্প কোনো প্রস্তাব রয়েছে কিনা।

সুলতানা কামাল : বিএনপির দাবি সম্পর্কে আমার কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে। তাই সে ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য নির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এবং একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত হবে- এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। চূড়ান্ত পর্যায়ে নির্বাচনের শুদ্ধতা নির্বাচন কমিশনের ওপরই নির্ভর করবে। তাই জনগণ একটি শক্তিশালী দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কমিশন পেতে চায়। আমার কাছে এটা পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রশ্ন- যেখানে যাঁর ওপর বা যাঁদের ওপর নির্বাচন সম্পাদনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তাঁরা কোনো রাগ-অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে বিবেকের সঙ্গে, জবাবদিহির সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন।

সমকাল : নির্বাচন কমিশন আসন্ন সংসদ নির্বাচনে দেড়শ আসনে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে, যা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

সুলতানা কামাল : মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের জন্য ইভিএম পদ্ধতির থেকে অনেক বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা এবং অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক সদিচ্ছা। ইভিএম ব্যবহার না করেই অতীতে নির্বাচন হয়েছে। সব দল কি মেনে নিয়েছে যে, নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে?

সমকাল : নির্বাচন এলে দেখা যায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে, তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই নির্বাচন এলেই ভীতির মধ্যে থাকেন। এ ধরনের পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে কী করণীয়?

সুলতানা কামাল : এ বিষয়ে এককথায় কিছু বলা যায় না। এটা একটা সমাজের চিন্তা, চেতনা, শিক্ষা, বোধ এবং বিবেকের সঙ্গে জড়িত। নির্বাচন এলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া একটি সমাজের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক অবক্ষয়ের পরিচয় রাখে। এর উত্তরণ ঘটাতে সমাজের গভীরে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে তার অব্যাহত চর্চার পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। সরকার ও নাগরিকদের একসঙ্গে মিলে একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার বিশ্বাস নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।

সমকাল : সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে নির্বাচন কমিশন কী করতে পারে?

সুলতানা কামাল : এ বিষয়ে কোনো চটজলদি সমাধান দেওয়ার কোনো তত্ত্ব আমার জানা নেই। তবে একেকটি নির্বাচনে- সেটা স্থানীয় সরকার বা জাতীয় যে পর্যায়েরই হোক না কেন- মুক্ত, অবাধ এবং সর্বজনগ্রাহ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে জনসাধারণ আগ্রহী হবে নিশ্চয়ই। নির্বাচন সাধারণ মানুষের জীবনে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। সূএ : সমকাল

পরিচয়/সোহেল

শেয়ার করুন