যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা ৪৪ বছরের ডায়ানা। তার বেড়ে ওঠা রক্ষণশীল এক খ্রিস্টান পরিবারে। সব সময়ই নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে লড়াই করেছেন এই নারী। নিয়তি ও সৃষ্টিবাদের মতো ধারণাগুলো কখনও তার কাছে অর্থবহ কিছু মনে হয়নি।
ডায়ানার ভাষায়, ‘আমার বিশ্বাস হারানো ছিল ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটি প্রক্রিয়া। কিছু ক্ষেত্রে একজন নারী হিসেবে নিজেকে আমার পুরুষের অধীনস্থ মনে হয়নি।’ তার বিশ্বাসে চিড় ধরার শেষ ঘটনাটি ছিল, ক্যানসারের তার বাবার মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা। ব্যথা উপশমের বদলে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায়’ নিরাময়ের জন্য অপেক্ষা করা হয়েছিল। ডায়ানার ভাষায়, ‘অবশেষে নিজের কাছে এটা স্বীকার করি যে, আমি অতিপ্রাকৃত সত্তায় বিশ্বাস করি না এবং আর ভান করে থাকা যায় না।’
ডায়ানা এখন একজন নাস্তিক। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে আলাপকালে আরও অনেকেই নিজেদের এমন মনোভাবের কথা জানিয়েছেন। ব্রিটেনের সাম্প্রতিক আদমশুমারির তথ্য বলছে, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীদের হার কমছে। শুমারির পর দ্য গার্ডিয়ান বেশ কয়েকজনের সঙ্গ কথা বলেছে, তারা জানিয়েছেন কেন নিজেদের আর খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দিতে চান না।
ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে নিজেদের খ্রিস্টান হিসেবে পরিচয় দিয়েছে ৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ। এক দশকের মাথায় ২০২১ সালে এই হার ৪৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে আলাপকালে ডায়ানার মতো অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ তাদের জীবনের সুনির্দিষ্ট কোনও ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। এসব ঘটনা হঠাৎ করে স্পষ্ট করে দেয় যে, তাদের মূল্যবোধ আর খ্রিস্টান ধর্মের শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
‘শিক্ষাগুলো রূপকথার মতো মনে হতে শুরু করে’
বার্মিংহামের একজন বাসিন্দা ৪৪ বছরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার জেমস। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেন যে, তিনি বড় হয়েছেন খ্রিস্টান মতবাদের এমন কিছু চিন্তাধারার সঙ্গে যা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার সঙ্গে বেমানান।
তার ভাষায়, ‘আমি একজন খ্রিস্টান হিসেবে বড় হয়েছি। প্রতি রবিবার গির্জায় যেতাম। গির্জার স্কুলে রাতের খাবারের আগে ঈশ্বরের অনুগ্রহের কথা বলতে শেখানো হয়েছিল।
তিনি বলেন, “কৈশোরের শেষের দিকের কিছু সময়ে সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের ধারণার মতো বিষয়গুলো আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একটি একটি রূপকথার মতো মনে হতে শুরু করে; যা আপনি বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর জন্য বলে থাকেন। আমার মধ্যে প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। তারপর আমি ভাবলাম, ‘যদি ঈশ্বর জানেন যে আমি কী করতে যাচ্ছি এবং এটি ঘটতে দেন, তাহলে আমার আর কোনও স্বাধীন ইচ্ছা অবশিষ্ট থাকে না’।”
জেমস নিজেকে এখন একজন নাস্তিক হিসেবে বর্ণনা করেন। ধর্মকে তিনি ‘জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং জনস্বাস্থ্য-বিষয়ক পরামর্শ প্রদানের পুরানো পদ্ধতি’ হিসেবে বিবেচনা করেন। যদিও তিনি তার দুই মেয়েকে গির্জার স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন।
তার ভাষায়, ‘আমি আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মের মূল্য দেখতে পাচ্ছি। আমি আমার সন্তানদের নিজেদের জন্য বিষয়টি খুঁজে বের করার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলাম।’ এর ফলাফল? জেমস বলছিলেন, ‘যখন আমার সাত বছর বয়সী মেয়েকে স্কুলে বলা হয়েছিল যে, ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তখন সে তার শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছে, আচ্ছা, ঈশ্বরকে কে সৃষ্টি করেছেন?’ তিনি জানান, এই শিক্ষাগুলো তার সন্তানদের আকর্ষণ করতে পারছে না।
‘সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গির্জা বদলায়নি’
ব্রিস্টলের বাসিন্দা ৫৪ বছরের পলিন। অবসরপ্রাপ্ত এই নারী বলছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্মের নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষা তার মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে হাজির হয়েছে।
পলিন বলেন, ‘আমার বয়স যখন ৩০-এর ঘরে তখন নিজেকে খ্রিস্টান বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি আইরিশ পিতামাতার সঙ্গে একজন কঠোর রোমান ক্যাথলিক হিসেবে বড় হয়েছি। আমরা সবসময় রবিবার গির্জায় যেতাম। আমার শৈশবের বেশিরভাগ সময়জুড়েই এটি ছিল একটি সুন্দর ও স্বস্তিদায়ক আচার অনুষ্ঠান।’
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পলিনের সন্দেহ হতে শুরু করে। তার ভাষায়, ‘আমি অনুভব করেছি যে, ঈশ্বর যদি প্রত্যেককে তার ভাবমূর্তির আলোকে তৈরি করেন, তাহলে কেন সমকামী লোকজন গির্জার ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবে? যেন তারা বলছে, যীশু সবাইকে ভালোবাসেন; কিন্তু শুধু যদি তারা আমাদের মতো হয়।’
পলিনের মতে, গির্জা এক ধরনের ঘৃণার বেসাতি ছড়াচ্ছিল। এর সঙ্গে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। তার ভাষায়, ‘যাবতীয় জাহান্নাম এবং অভিশাপের পাশাপাশি ক্যাথলিক চার্চের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ থাকার ঘটনায় পুরো বিষয়ে সম্পূর্ণ মোহভঙ্গ করেছে।’
মাঝেমধ্যেই অবশ্য নিজের খ্রিস্টান বিশ্বাসের অভাববোধ করেন পলিন। তবে তিনি নিশ্চিত, আর ধর্ম বিশ্বাসে ফিরবেন না। তার ভাষায়, ‘আমি মারা গেলে সরাসরি শবদাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোনও ধর্মীয় পরিষেবা নয়।’
‘আমি অনেক বেশি শান্তি অনুভব করছি’
লন্ডনের বাসিন্দা ২৮ বছরের স্টিফেন হুনসেকার। কোভিড লকডাউনের সময় তিনি ধর্মবিশ্বাস থেকে সরে আসতে শুরু করেন। এ সময় তিনি দেখতে পান, যখন তিনি আর তার ধর্ম পালন করছেন না তখন তিনি ‘অনেক ভালো’ অনুভব করছেন।
স্টিফেন হুনসেকার জানান, তিনি সারা জীবন খুব ধার্মিক একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু লকডাউনের সময় তিনি তার বিশ্বাস থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে অনুধাবন করেন, তার র্ধ্মবিশ্বাসে এমন অনেক কিছু রয়েছে বাস্তবে যা তিনি ধারণ করেন না।
তার ভাষায়, ‘আমি অনুভব করেছি যে, আমাকে প্রতিটি বাঁকে এটিকে ন্যায্যতা দিতে হবে। এটি আমার মধ্যে ব্যাপক অপরাধবোধ তৈরি করে।’ সংখ্যালঘু ও সমকামীদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের আচরণ নিয়েও তার অস্বস্তি ছিল। স্টিফেন হুনসেকার বলেন, ‘ধর্মের মানে বোঝানো হয়, আপনাকে একজন ভালো মানুষ হতে সাহায্য করা। কিন্তু আমি অনুভব করেছি যে, এটি আমাকে আটকে রেখেছে।’
হুনসাকারের মতে, ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করা ছিল তার সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। আমি খুব ভয়ে ছিলাম পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে আমার সম্পর্ক প্রভাবিত হবে–তাদের ঘিরেই ছিল আমার পৃথিবী। কিন্তু যতটা খারাপ হবে ভাবছিলাম তার চেয়ে ভালো ছিল।
‘একটি অবিশ্বাস্য শক্তিশালী আবেগ হলো অপরাধবোধ, কিন্তু আমি যখন ধর্মবিশ্বাস ছাড়াই জীবনযাপন করছিলাম এবং এর প্রতি অন্যদের সংহতি আমাকে নিজেকে চেনার সুযোগ দেয়। এখন আমি অনেক বেশি শান্তিতে আছি।