ওয়াক ওভার। ‘রাতের ভোট’। গেল দু’টি নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সে বিবেচনায় ফখরুদ্দীন-শামসুল হুদার ঊনত্রিশে ডিসেম্বরের নির্বাচন প্রশংসিত। সরকারি দলের নেতারা তা স্মরণ করিয়ে দেন মাঝে মধ্যেই। বিএনপি নেতারাও এ প্রসঙ্গে নীরব। তবে নীরবতা ভাঙলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। বিএনপি’র প্রভাবশালী এ নেতার সাফ কথা, ওটা ছিল ‘চোরাই’ নির্বাচন। বিএনপি’র জন্য ফাঁদ। জানালেন আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে যেতে রাজি ছিলেন না বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। একটি মিত্র দল জোর করেছে। আমি শুনেছি, তাদের পক্ষ থেকে ম্যাডামকে বার বার বলা হয়েছে, নির্বাচনে যান। না হয় দীর্ঘমেয়াদে মার্শাল ল’ ডিক্লেয়ার করবে। আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘খালেদা জিয়া আমাকে বলেছিলেন তিনি ন্যূনতম পক্ষে জুন-জুলাইয়ের আগে ইলেকশনে যাবেন না।’ তিনি সে সময়কার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন, আমাদের ধারণা ছিল ফেব্রুয়ারি বা মার্চের আগে আমাদের সব নেতাকর্মী কারাগার থেকে বের হবেন। বিএনপিকে যদি একটা ভালো ইলেকশন করতে হয় তাহলে মিনিমাম ৩ থেকে ৪ মাস লাগবে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। সম্প্রতি নিজ ব্যবসায়িক কার্যালয়ে মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি’র এই ভাইস চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন। মানবজমিনের প্রধান বার্তা সম্পাদক সাজেদুল হক ও স্টাফ রিপোর্টার নূরে আলম জিকু সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন। সঙ্গে ছিলেন আলোকচিত্রী জীবন আহমেদ।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ২০০৮ সালের চোরাই মার্কা নির্বাচনে বিএনপি’র অংশ নেয়া ছিল ভুল। হুদা কমিশন বড় বড় কথা বলে বেড়ায়। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরি হয়েছে হুদা কমিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন নির্বাচনে। সেই চোরাই নির্বাচনই আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বেশকিছু আসন আছে যেসব আসনে ’৭৩ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ জিতেনি। অথচ ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জেতানো হয়েছে। বিএনপি’র ভুল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি’র অংশ না নেয়াটা ছিল ভুল। তখনও আমরা সরকারের ফাঁদে পা দিয়েছি। উপরে উপরে সংলাপের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার চেয়েছিল আমরা যেন নির্বাচনে না যাই। আমরা যেন নির্বাচনে না যাই এজন্য এমন কিছু নেই যা সরকার করেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়া ভুল-শুদ্ধ কিছুই বুঝি না। তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস আগামী নির্বাচনে গত নির্বাচনগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না।’ বিএনপি’র এই ভাইস চেয়ারম্যানের কথা, ‘যদি ইলেকশন হয় তা হবে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। যদি না হয় সে প্রশ্নের উত্তর এখন আমার কাছে নাই।’ একটি সঠিক নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার কিছুটা বেশি সময় নিলেও আপত্তি নেই তার।
আবদুল আউয়াল মিন্টুর ক্যারিয়ার বর্ণাঢ্য। তরুণ বয়সে জাহাজের চাকরিতে যোগ দেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। চাকরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ব্যবসায় নেমে পেয়েছেন সফলতা। হয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ নেতা। রাজনীতিতে তিন দশকের বেশি পথচলা । ছিলেন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ। অনেকদিন হলো সক্রিয় বিএনপিতে। রাজনীতির অন্দরমহলে বিস্তর পদচারণা আবদুল আউয়াল মিন্টুর। একসময় প্রধান দুই শিবিরের শীর্ষ নেতাদেরই ঘনিষ্ঠ মনে করা হতো তাকে। লেখালেখি করেন দীর্ঘদিন ধরে। ব্যবসা ও রাজনীতির ব্যস্ততা তার সময়ানুবর্তিতার ওপর প্রভাব রাখতে পারেনি। গেল রোববার দুপুরে পূর্ব-নির্ধারিত সময়েই দেখা দেন আমাদের। দ্রুতই প্রশ্নে চলে যাই আমরা। বিএনপি’র এই নেতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেন তার বিশ্বাস, গত দুটি নির্বাচনের মতো নির্বাচন আর হবে না? পরিষ্কার করেই ব্যাখ্যা করলেন তিনি। তার জবাব ছিল এরকম- গ্রামে একটা কথা আছে, দশদিন চোরের একদিন গেরস্তের। আমরা তো সারা দেশ ঘুরি। যেটা মনে হয় দেশের জনগণ তাদের চুরি হয়ে যাওয়া ভোটাধিকার ফেরাতে সচেষ্ট। এটা প্রথম কথা। আরেকটা কথা আমরা স্বীকার করি বা না করি বর্তমান সরকারের প্রতি কোনো কোনো বৃহৎ শক্তির একটা সমর্থন ছিল। আগামীতে কিছুতেই সে সাপোর্ট তারা পাবে না। তৃতীয়ত বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো, তারা চায় বাংলাদেশে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। গণতান্ত্রিক দেশ বলতে তারা বৃহৎ শক্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং রাজনীতিতেও তারা ঝুঁঁকি গ্রাহক, স্টেকহোল্ডার।
আমেরিকার কথাই ধরুন যেখানে আমরা সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করি, যেখান থেকে আমাদের অন্যতম বড় রেমিট্যান্স আসে। জাতিসংঘ, আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকেও আমেরিকার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের দেশ যখন অবাধ নির্বাচন চায়; তখন অন্য কোনো দেশ যদি অবৈধ নির্বাচনের পক্ষেও থাকে তা সম্ভব হবে না। আরেকটা কথা অর্থনীতি। আমি বলবো না অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে তবে, এমন সংকটের মুখামুখি যা বর্তমান সরকারের দ্বারা উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে সরকারি দলের নেতারা আকুণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এমন একটি সরকার আবার ক্ষমতায় আসবে তা কিছুতেই সম্ভব না।
তাহলে কেমন হবে সে নির্বাচন? জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি ইলেকশন হয় তা হবে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। যদি না হয় সে প্রশ্নের উত্তর এখন আমার কাছে নাই, তবে এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচন হতে দেবে না।’ তাহলে ইলেকশন না হওয়ার সম্ভাবনাও আপনি দেখেন? উত্তরে আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, না হওয়া বলতে, আর কয়েকদিন দেরি হওয়াতে তফাৎ তো কিছু নেই। একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেন, জাতীয় সরকার বলেন, নিরপেক্ষ সরকার বলেন যে নামেই অভিহিত করেন, যদি কোনো একটা সরকার গঠন করেন সেখানে একটা তো সময় লাগবেই। ফ্রেমওয়ার্ক ঠিক করা। মনে করেন আমরা চাচ্ছি ইলেকশন কমিশনকে পুনর্গঠন করা, নতুন ইলেকশন কমিশন চাই, এগুলোতো বললেই হবে না। এগুলোর জন্য একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হবে। ৩ মাস না হলে ৬ মাসে হবে মনে করেন। বিএনপি’র এই নেতা আরও বলেন, আপনি তো ৩ মাস ধরে নিচ্ছেন বা ধরে নিচ্ছেন জানুয়ারির ৯ তারিখ লাস্ট ডেট কিন্তু এমনও হতে পারে সরকার আগাম একটা নির্বাচন দিয়ে দিতে পারে পার্লামেন্ট ভেঙে। সরকার যা ইচ্ছা তাই করুক। কিন্তু এদের অধীনে বাংলাদেশের জনগণ কোনো নির্বাচন হতে দেবে না। এদের বিদায় করে সবাই মিলে বসে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, বিএনপি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল। সবচেয়ে বেশি সমর্থিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে তাদের লিড করা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে বিএনপি’র ব্যর্থতা দেখেন কি-না? জবাবে আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আছে। অবশ্যই অনেক ব্যর্থতা আছে। নির্বাচন সমাজের সর্বত্র থেকে বিদায় নিয়েছে উল্লেখ করে এফবিসিসিআই’র এই সাবেক সভাপতি বলেন, এখন কোথায় নির্বাচন হয়? কোনো সামাজিক সংগঠনেও নির্বাচন হতে পারে না। সেটা চাঁপাই নবাবগঞ্জ সমিতি বলেন, আর বিজিএমইএ বলেন, কোথাও নির্বাচন হয় না। নির্বাচন বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে।
এটা অনেক আলোচিত, তবুও জিজ্ঞেস করি বিএনপি চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কেউই নির্বাচনে যোগ্য নন। এ অবস্থায় বিএনপি যদি ক্ষমতায় যায়, প্রধানমন্ত্রী হবেন কে? এ প্রশ্নের উত্তরে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বিএনপিতে অন্তত এক হাজার লোক আছে যারা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য।তার নিজের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি উত্থাপন করলে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ১৫ বছর ধরেই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তো কোনো চার্জ আনেনি। এ অভিযোগ চালু আছে আমার স্ত্রী, ছেলে সবার নামে। কিন্তু কথা হচ্ছে অর্থপাচার তো হচ্ছে। সব জায়গায় বেগমপাড়া, দ্বিতীয় হাউস ইত্যাদি। কেন আমরা এটা বন্ধ করতে পারছি না? কেন আমরা কমিশন করে বের করছি না কারা এটা করছে? অর্থপাচার করে তারাই যারা অর্থ লুণ্ঠন করে, যারা দুর্নীতিবাজ। যারা মুদ্রা পাচার করে তাদের ধরছে না কেন? ব্যাংক থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হলো এগুলো করলো কারা? বিএনপি’র লোকেরা করেছে? সুত্র মানবজমিন
এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়