আমাদের জীবদ্দশায় এইরকম অভিজ্ঞতা দ্বিতীয়বার হবে কিনা আমার জানা নেই। আমরা এক ভয়াবহ মহামারির কাল অতিক্রম করছি। করোনা নামের এই অদৃশ্য দানব আমাদের তাড়া করে ফিরছে। সমস্ত পৃথিবী যেন এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পতিত। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে; মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। একধরনের আতংক আমাদের চারিপাশে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমস্ত বিশ্বব্যপী করোনা নামক এই দানবকে রুখতে নানা ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তার অন্যতম হচ্ছে সামাজিক দূরুত্ব মেনে চলা অথবা বিচ্ছিন্নবাস বা স্বেচ্ছা অন্তরীণ। মানুষকে ঘরে রাখার জন্য তাই লকডাউন প্রথার প্রবর্তন হোল বিশ্বব্যপী। আমাদের দেশেও সাধারণ ছুটির ঘোষণা এলো মার্চের ১৭ তারিখ থেকে। সরকারের প্রাণান্তকর চেষ্টা সবাইকে ঘরে রাখার। আর্মি, পুলিশ রাস্তায় নেমে এলো, জবরদস্তিমূলকভাবে হলেও মানুষকে ঘরে রাখতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে।
আমি মার্চের ২০ তারিখে আমাদের পৈত্রিক নিবাসে টাংগাইলে চলে যাই, আমার মায়ের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীর সুবাদে শীত গ্রীষ্মের ছুটি বরাদ্দ থাকে এবং তার দৈর্ঘ বেশ বড়ই হয়। এই ছুটিগুলো আমি আমার পৈতৃক নিবাসে মায়ের সাথে কাটাতে পছন্দ করি। ওই সময়টায় আমি ছবি আঁকায় বেশ মনোনিবেশ করতে পারি। এবারও তার ব্যতিক্রম হোল না। ধারণা ছিল এই ছুটি বা বিচ্ছিন্নবাস অনেক দির্ঘায়িত হতে পারে। তাই এই যাত্রায় কিছু পুস্তক এবং রংতুলি আমার সঙ্গী হয়েছিল। দুটি ঢাউস সাইজের বই আমার সঙ্গী, হাবিব ভাই অনূদিত মার্কেসের একশ বছরের নিঃসঙ্গতা, ও তপন রায় চৌধুরীর বাঙ্গালনামা। এই বইগুলো দীর্ঘদিন আমার বুক সেলফ এ শোভা পাচ্ছিল। পড়া হয়ে ওঠেনি। এই দীর্ঘ অবকাশে হয়তো পড়া হয়ে উঠতে পারে। আমাদের বাড়িটিতে প্রচুর গাছপালা থাকায় এবং বাড়িটির আদি ও অকৃত্রিম চরিত্রটি বজায় থাকায়, দিনের পর দিন মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়া যায়, আর সাথে যদি থাকে রঙতুলি, তবে তো কথাই নাই। যেহেতু একটা দীর্ঘসময় আমাকে স্বেচ্ছা-অন্তরীণ থাকতে হবে, তাই এই নিসর্গ নিবাসই উৎকৃষ্ট সিদ্ধান্ত হতে পারে। এখানে সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। নানাবর্ণের পাখির অবাধ বিচরণ। দোয়েল, ঘুঘু, বুলবুলি, ফিংগে, সাত ভায়লা, শালিক আরো নাম না জানা অসংখ্য পাখি। আম, কাঠাল, মেহগনী, জামরুল, বাতাবী লেবু, আরো অনেক গাছের ছায়ায় এই বাড়িটি সত্যিই যেন একটি শান্তির নিবাস। বাগানে নানা রঙের ফুলের সমাহার। রঙ্গন, জবা, বেলী, নয়নতারা, ব্লিডিং হার্ট, কসমস প্রতিদিন এখানে সৌরভ ছড়ায়। আমি বন্ধুদের ফোনে প্রায়ই বলতাম, এই লকডাউনে আমি সবচেয়ে প্রিভিলেজড। বন্ধুরা হায়হুতাশ করে, আহা আপনি কত স্বর্গে আছেন, আর আমরা এই কংক্রিটের শহরে চার দেয়ালে বন্দী।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বড়ির আঙ্গিনায় প্রাতঃভ্রমন করি, কয়েকটি ঘুঘু ঘুর ঘুর করে, আবার উড়ে যায়। পাখিরা সব জেগে উঠে সকালেই, শুরু হয়ে যায় তাদের সিম্ফনি। ধীরে ধীরে সুর্য উঠে, ঘনবৃক্ষের ফাক গলিয়ে রোদের উঁকি, প্রভাত থেকেই শুরু হয়ে যায় এই আলোছায়ার খেলা, যা চলে দিনমান। এরমধ্যেই কোন এক ফাইন মর্নিং এ আমার ছবি আঁকা শুরু হয়, বলা যেতে পারে শুরু হোল আরেকটি নতুন শিল্পযাত্রা। আমাদের বাড়িতে একটা বেশ বড় বারান্দা আছে, এখানেই আমার অস্থায়ী স্টুডিও। এখানে বসলেই মন ভালো হয়ে যায়। এখানে বসেই দেখা যায় প্রজাপতিদের উড়াউড়ি, পাখিদের জলকেলি আর চোখ ভরে উঠে সবুজে। আমি খুব বেশী ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে যেতে পারি নাই। একটি স্কেচ খাতা, কিছু রংতুলি আর কয়েকটি বল পেন। আমি প্রতিদিন সকালে নাস্তা সেরে কাজে লেগে যাই, আমার বারান্দা স্টুডিওতে বসে। সবুজ ঘেরা এই প্রকৃতিই যেন আমার উপর ভর করে, আর আমার ছবির উপজীব্য হয়ে ওঠে। বৃক্ষ, আলোছায়া এই সবই ছবির অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। আমার ছবি আঁকার পদ্ধতি হচ্ছে কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত ধরনের। আমি সরাসরি প্রকৃতিকে অনুকরণ করি না। আমি অনেকটা না ভেবেই তুলির আঁকিবুকির মধ্য দিয়ে লক্ষে পৌঁছোনোর চেষ্টা করি। অর্থাৎ গন্তব্য না ভেবেই যাত্রা শুরু করা। লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে আমি একটু নতুন আঙ্গিকে ছবিগুলো আঁকার চেষ্টা করি। প্রথমে জলরঙে ওয়াশ দিয়ে তারপর বলপেন দিয়ে ডুডল-এর মতো আঁকিবুকি করি অথবা পেন স্কেচ আঙ্গিকে আঁচড় কেটে একধরনের গভীরতা তৈ্রীর চেষ্টা করি। আমার ছবি অনেকটা অবচেতনের কাব্য। তবে অদ্ভুত ব্যাপার আমি যতই non representational ছবি আঁকার চেষ্টা করি না কেন, ঘুরেফিরে নানাধরনের দৃশ্যাবলী ছবিতে এসে যায়। এই লকডাউন পর্যায়ের ছবিগুলোতে সবসময় একটি বিষয়ই ঘুরে ফিরে এসেছে, যেমন, অনেক গাছপালা, একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়, তার মাঝখান থেকে আলো বেড়িয়ে আসছে। এটি বোধহয় এই সময়েরই একটি প্রতিবিম্ব। সত্যিই তো, আমরা তো এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের আলো দরকার, অনেক আলো। এই ছবিগুলো কেমন হচ্ছে এ বিষয়ে আমি একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম, আসলে কি দাঁড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না, কারণ এই ছবিগুলো আমার নতুন নিরীক্ষা। এই সিরিজের কয়েকটি ছবি আমি ফেসবুকে পোস্ট করি। ‘করোনা সময়ের স্কেচবুক থেকে’ শিরোনামে ছবিগুলো ফেসবুকে লকডাউনের সময় প্রতিনিয়ত আপলোড করতে থাকি। ফেসবুকে বেশ ভালো সারা পাই, আমার বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রী, শুভানুধ্যায়ী, নবীন প্রবীন শিল্পীরা সবাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। এই লকডাউনের সময়ে নিঃসঙ্গতার এই কালে আমার শিল্পীবন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের এই appreciation আমাকে যেন নবসঞ্জিবনী প্রেরণা দান করল। ফেসবুকে ছবি দেখে মন্তব্য করেছেন সদ্যপ্রয়াত খ্যাতনামা শিল্পী মুর্তজা বশীর, আরো অনেক জ্যেষ্ঠ শিল্পী যেমন মোহাম্মদ ইউনুস, কাজী রকিব, খাজা কাইয়ুম, নাসির আলী মামুন, শিল্পী নাজমা আক্তার প্রমুখ।
টানা তিনমাস টাংগাইলে ছিলাম। এই সময় প্রতিদিন কাজ করেছি। সারাদিন ছবি আঁকা, আর রাতে বই পড়া। গান শোনা একটি বড় অনুষঙ্গ আমার শিল্পচর্চার। মোজার্ট, বেটোফেন, চাইকোভোস্কির সংগীত সুধায় ভেসেছি, আরো শুনেছি কিশোরী আমোনকর, পন্ডিত যশরাজ, ভিমসেন যোশী, আমার পছন্দ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মার্গীয় সংগীত। শিল্পচর্চার জন্য একধরনের আইসোলেশন দরকার। আমরা সবসময় ব্যস্ত নানা ধরনের কর্মকান্ডে, করোনা আমাদের একটি অখন্ড অবসর এনে দিয়েছে, যা একাগ্রভাবে শিল্পচর্চার জন্য উপযোগী। আমার কাছে করোনার সময় শিল্পচর্চা এক ধরনের আর্ট থেরাপিও বটে। শিল্পচর্চার মধ্য দিয়ে নানা ধরনের ট্রমা থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
টানা তিন মাস টাংগাইলে থাকার পর ঢাকার দিকে যাত্রা করি, ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল হতে থাকে। ঢাকায় এসে আমার কর্মস্পৃহা থেমে থাকেনি। ঢাকাতেই আমার স্টুডিও কাম বাসা, সুতরাং এখানে আমার ছবি আঁকার ম্যাটেরিয়াল যথেষ্ট পরিমান আছে, ক্যানভাস রং তুলি কোন কিছুরই অভাব নাই। এখানে বেশ কিছু ছোট সাইজের ক্যানভাস আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। আমি এই ক্যানভাসগুলোতে টাংগাইলে যে কাজগুলো করেছি তারই ধারাবাহিকতায় নতুন করে আবার শুরু করলাম। এই ছবিগুলোতে সবুজ আর নীলের আধিক্য, নীলের আধিক্য বোধহয় একটু বেশী, তাই বন্ধুরা অনেকে মজা করে বলে, রশীদ আমিনের ব্লু(blue period) পিরিয়ড। বৃক্ষলতা ও মেঘমালা অথবা মেঘের রাজ্য ও বৃক্ষ এই ধরনের বিষয়গুলো ঘুরে ফিরে আসে।
ক্যানভাসে এক্রিলিক রং দিয়ে একটি জমিন তৈরী করি, অতঃপর কিছুটা চিকন তুলি কালো চাইনিজ ইঙ্কএ চুবিয়ে রেখার পর রেখা টেনে একটা অবয়ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। রেখাগুলি কখনো সুক্ষ্ণ, কখনো মোটা। এইভাবেই তৈরী হয় আকাশে মেঘের রাজ্য আর নিসর্গের খেলা। তুলিগুলো টানার সময় একধরনের মেডিটেশন অনুভব করি। প্রাচীন যুগের চীনা সন্নাসী শিল্পীরা চিত্রাংকনের মধ্য দিয়ে পরম সিদ্ধি লাভের চেষ্টা করতো। করোনাকালের এই সময়ে যখন চারিদিকে এতো মৃত্যু, এতো জড়া, এতো উলটপালট, এই সময় একজন শিল্পীর কী করনীয়? আমি মনে করি রংতুলির জগতে প্রবেশ করাই একমাত্র করণীয়। তিনি ধ্যানস্থ হবেন এবং ক্যানভাস বর্নিল হয়ে উঠবে, অতঃপর সময়ের শুশ্রুষা হবে এবং কেটে যাবে এই কালবেলা।
এই করোনাকালে আমি বিভৎস করোনা ভাইরাসের ছবি আঁকতে চাইনি। বরং আলো আঁধারির মধ্যে এক ধরনের আশাবাদ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।