নিউইয়র্ক     সোমবার, ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৫শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কানাডায় বাংলাদেশীদের এক-তৃতীয়াংশই গিয়েছে গত এক দশকে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২২ | ০১:২৭ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২২ | ০১:২৭ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
কানাডায় বাংলাদেশীদের এক-তৃতীয়াংশই গিয়েছে গত এক দশকে

কানাডায় গত বছর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য প্রকাশ হয়েছে গত ২৬ অক্টোবর। এতে দেখা গিয়েছে, দেশটিতে এ মুহূর্তে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছে ৭০ হাজারের বেশি, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি গিয়েছে ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে।

বাংলাদেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পছন্দের গন্তব্যের তালিকায় কানাডার অবস্থান এখন শীর্ষে। এর কারণ হিসেবে দেশটির সামাজিক সুরক্ষা ও জীবনযাত্রার মানকেই চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, পরিবেশ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা থেকে শুরু করে সামাজিক নিরাপত্তা ও জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে কানাডার শহরগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে। আবার দেশটিতে আইনের নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে অর্থ ও সম্পদ পাচার করে বিনিয়োগকারী কোটায় অভিবাসনের সুযোগও নিয়েছেন অনেকে। এছাড়া কেউ কেউ আইনের নাগাল এড়াতে বা শরণার্থী হিসেবেও যাচ্ছেন।

কানাডা সরকার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বাংলাদেশী অভিবাসী রয়েছে ৭০ হাজার ৯০ জন। এর মধ্যে ২০১১ থেকে ২০২১—এক দশকে গিয়েছে ২৫ হাজার ৩৬০ জন। তার মধ্যে ২০১১-১৫ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গিয়েছে ১২ হাজার ১৮৫ জন। ১৩ হাজার ১৮৫ জন গিয়েছে ২০১৬-২১ সালের মধ্যে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, গত এক দশকে গোটা দক্ষিণ এশিয়া থেকে অভিবাসী গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কানাডার ভিসা প্রক্রিয়া অনেক শিথিল ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে কানাডার কোটাও রয়েছে। শিক্ষার্থী ও অন্যান্য ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে গত এক দশক অনেক সহজ সময় ছিল। সার্বিকভাবে কানাডা অভিবাসী গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনেক নমনীয় ছিল। এ কারণেই সংখ্যাটা গত এক দশকে বেশি দেখা যাচ্ছে। কানাডায় যারা গিয়েছে, তারা ভিসা নিয়েই গিয়েছে। দেশটিতে অবৈধভাবে যাওয়ার পথ নেই বললেই চলে।

উন্নত জীবনের প্রলোভন ও ভাগ্যান্বেষণে পাশ্চাত্যের দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ খোঁজার প্রবণতাটি বেশ পুরনো বলে সমাজবিজ্ঞানীদের নানা আলোচনায় উঠে এসেছে। আবার গত এক দশকে দেশ থেকে অবৈধ অর্থ স্থানান্তর করে স্থায়ী অভিবাসনের ঘটনাও ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কানাডায় বিনিয়োগ কোটায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়াদের একটা অংশ দেশ থেকে দুর্নীতি, ব্যাংকঋণের খেলাপ ও সরকারি সম্পদ আত্মসাতের মাধ্যমে অবৈধভাবে ধনী হয়ে কানাডায় বিলাসী জীবন যাপন করছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আবার চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী।

চট্টগ্রামের বাদশা গ্রুপের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইসা। কয়েকটি ব্যাংকের ৬০০ কোটি টাকারও বেশি ঋণ পরিশোধ না করে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন তার ভাই মোহাম্মদ মুসাকেও। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহীম। প্রায় হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি রেখে বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন তার মালিকানাধীন ক্রিস্টাল গ্রুপের তিন কর্ণধার ও পরিবারের সদস্যরা। তিনি নিজেও কানাডা-বাংলাদেশ আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন।

ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করেই কানাডায় স্থায়ী আবাস গড়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী দিদারুল আলম। দেশে থাকাকালীন নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইফফাত ইন্টারন্যাশনালের নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেন তিনি। অভিযোগ আছে, টাকার সিংহভাগই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে নিজেও সপরিবারে কানাডায় চলে গিয়েছেন।

২০১০ সালের দিকে ইস্পাত, শিপব্রেকিং ও আবাসন ব্যবসার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন মিশম্যাক গ্রুপের কর্ণধার তিন ভাই হুমায়ুন কবির, মিজানুর রহমান শাহীন ও মুজিবুর রহমান মিলন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নেন। এর মধ্যে মিজানুর রহমান শাহীন ও হুমায়ুন কবির বর্তমানে সপরিবারে কানাডায় অবস্থান করছেন। ১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮০০ কোটি টাকার বেশি পাওনা না দিয়ে বর্তমানে সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছেন আরেক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন। তিনি শিপব্রেকিং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ম্যাক ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার।

শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুটকারী ব্যবসায়ী নয়, সরকারি অনেক কর্মকর্তাও কানাডায় পাড়ি জমানোদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। দুর্নীতি ও এর মাধ্যমে উপার্জনকৃত অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও।

বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেসব বাংলাদেশী বিনিয়োগকারী কোটায় কানাডায় পিআরের (পারমানেন্ট রেসিডেন্সি বা স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা) সুযোগ পেয়েছেন, তাদের একাংশকে ঘিরেই এখন এসব অভিযোগ ঘুরপাক খাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বলা হয়, দেশ থেকে অবৈধভাবে সরানো টাকায় সেখানে বিলাসী জীবন যাপন করছেন তারা।

দেশের রফতানিকারকদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সীমিত অংশ ব্যবসায়িক কাজ পরিচালনার জন্য বৈধভাবে বিদেশে রাখার সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীসহ দেশের বেশকিছু রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা তাদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে না এনে কানাডায় রেখে দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশে থেকে গেলেও কানাডায় গড়ে তোলা সম্পদের দেখভাল করার জন্য পরিবারকে স্থানান্তর করেছেন সেখানে। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ পাচারকারীদের নির্মিত বিলাসবহুল বাড়িগুলোর রীতিমতো মহল্লা গড়ে উঠেছে সেখানে, যা মুখে মুখে প্রচার পেয়েছে ‘বেগম পাড়া’ হিসেবে।

তবে কানাডায় বাংলাদেশীদের মধ্যে বৈধ পন্থায় অভিবাসন গ্রহণকারী অথবা শিক্ষার্থী হিসেবে যাওয়াদের সংখ্যাই তুলনামূলক বেশি বলে জানিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, কানাডায় অন্যতম নমনীয় অভিবাসন নীতি রয়েছে। সেই সুবাদে অনেক বাংলাদেশী, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিয়েছে। আমি মনে করি না যে অভিবাসনের যে সংখ্যাটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রতিফলনটা অনেক বেশি। কানাডায় বাংলাদেশীদের বেশির ভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। এর মধ্যে বাংলাদেশে অর্থ পাচার করা অভিবাসী থাকতে পারে, তবে সে সংখ্যা মোট অভিবাসীর তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

অর্থ পাচার করে যারা কানাডায় বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে, তাদের সঙ্গে সেখানে বসবাসকারী অন্য বাংলাদেশীদের এক ধরনের দ্বন্দ্বও তৈরি হয়েছে বলে সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কানাডায় সরকারি সহযোগিতায় অভিবাসন নেয়া যায়। অভিবাসন নীতিও বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে কানাডায় তুলনামূলক সহজ। দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পরিকল্পিতভাবেই অনেক বেশি শিক্ষার্থী টানছে। বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী সেখানে বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন। আবার পারিবারিক অর্থবিত্তের জোরেও সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ভাষার সক্ষমতা দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তাদের টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টসহ নানা পেশায় কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে। এর সুবাদে অনেকে শিক্ষার্থী হিসেবে গিয়েও কানাডায় স্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছেন।

ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির বণিক বার্তাকে বলেন, অভিবাসীদের আগ্রহ কাজে লাগাতে কানাডা সরকারের এক ধরনের সমন্বিত একটি নীতি দেখা যায়। ভাষার সক্ষমতাও কানাডার কর্মক্ষেত্র ও স্থায়ীভাবে বসবাসের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের। দেশটির অভিবাসন নীতিও তুলনামূলক সহজ। অনেক সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যারা নিজের সন্তানদের কানাডায় পাঠাচ্ছেন শিক্ষার্থী হিসেবে। পরে সন্তানদের মাধ্যমেই নিজেরাও দেশটিতে স্থায়ী আবাস গড়ছেন। কানাডায় অভিবাসনের ক্ষেত্রে সন্তানদের পড়ালেখাটা হচ্ছে প্রথম ধাপ। এ সুযোগটা সরকারি কর্মকর্তারাসহ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও নিয়েছে। যারাই অর্থবিত্ত গড়ছেন, তারাই নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে কানাডাকে বেছে নিচ্ছেন।-বণিকবার্তা

শেয়ার করুন