নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, কূটনীতিকদের তৎপরতাও তত বাড়ছে। রাজনৈতিক বিষয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন তারা। রাজনৈতিক নেতারাও দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এবার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাত হলো আওয়ামী লীগ নেতাদের৷
ফলে একটা প্রশ্ন আরো জোরালো হলো- তাহলে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা কি কূটনীতিকদের ওপর নির্ভরশীল? এ বিষয়ে কূটনীতিকরা কতটা ভূমিকা রাখতে পারেন- জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আইডিয়ালি তো সুযোগ নেই, দরকারও নেই। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা উন্নত না হচ্ছে, যতক্ষণ না আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের দৌড়াদৌড়ি থাকবে। এটা আমাদের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ।”
গত এক বছর ধরে বিএনপি নেতারা কূটনীতিকদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে নানা সমালোচনাও হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। ওই দিন রাতে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদের বাসায় নৈশভোজের আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন পিটার হাসসহ মার্কিন দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা। সেখানেই বৈঠকটি হয়। এ সময় শাম্মী আহমেদ ছাড়াও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ম্যাথিউ বে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে মাহবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমাদের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদের বাসায় নৈশভোজের দাওয়াত ছিল এটি। কোনো দাওয়াতে গেলে যেসব কথাবার্তা হয়, তা-ই হয়েছে। এর বেশি কিছু নয়। তবে পিটার হাসের সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্ক আরো জোরদার করা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হয়। আমরা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ইপিজেডে মার্কিন বিনিয়োগের বিষয়ে কথা বলেছি। রাষ্ট্রদূত এসব বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। আমরা সব বিষয়ে সহযোগিতার কথা জানিয়েছি। শুধুমাত্র দুই দেশের সম্পর্কন্নোয়ন নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে।”
নির্বাচন বা রাজনৈতিক কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জনাব হানিফ বলেন, “না, এই ধরনের কোনো আলোচনা হয়নি। এটা আমি পছন্দও করি না। আমি মনে করি, আমাদের দেশে ভোট হবে সংবিধান অনুযায়ী। এখানে বিদেশিদের কিছু করার নেই।” বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠক করায় এতদিন তো আপনারা বিএনপির সমালোচনা করেছেন, তাহলে আপনারা এখন কেন বৈঠক করছেন? জবাবে হানিফ বলেন, “বিএনপি তো ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তখন তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা ছিল জনগনের বিরুদ্ধে। এমনকি ২০১৪-২০১৫ সালে আগুন সন্ত্রাসের কারণে জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে এখন জনগণের প্রতি তাদের আস্থা নেই। কূটনীতিকরাই তাদের ভরসা। আর আওয়ামী লীগের তো জনগণের উপর আস্থা আছে, ফলে অন্য কারো উপর ভরসা করতে হয় না।”
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি যুগ্ম সম্পাদক হারুনুর রশীদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কেবল তো শুরু। তারা আরো বৈঠক করবে। ১৯৮৬ সালে যখন এরশাদ ক্ষমতায় ছিল, তখনও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশে এটা তো নতুন না। আমাদের ব্যর্থতার কারণেই তো যারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী তাদের শরণাপন্ন হতে হয়। তারা বিএনপির যে সমালোচনা করে এর কোনো যুক্তি নেই। দেশের অর্থনীতি আজ কোথায় যাচ্ছে? বিএনপির একটা সমাবেশকে বন্ধ করার জন্য আপনি তিনদিন হরতাল দিচ্ছেন। তাদের সব বক্তব্যই স্ববিরোধী। এরপর তারা বিদেশিদের সঙ্গে আরো অনেক মিটিং করতে বাধ্য হবে। একটু অপেক্ষা করেন, সব দেখতে পাবেন।”
গত ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত ক্যানাডিয়ান রাষ্ট্রদূত নিকোলাস লিলির সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। সেখানে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়। এর আগে গত ৮ নভেম্বর ঢাকায় সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে ও নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন রিকটার ফেন্ডসেনের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। ওই বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “তাদের সঙ্গে মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সার্বিক যে ঘটনাগুলো ঘটছে, বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”
কূটনীতিকদের এই তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি মনে করি, যেহেতু আমাদের এখনও অর্থনৈতিকভাবে, রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা আছে এবং আরো কিছুদিন সেটা থাকবেই, সুতারাং দরকষাকষির ক্ষেত্রে এটা থাকবে। আর আক্ষেপের জয়গাটা হলো, হ্যাঁ, বুঝলাম, যারা শক্তিমান তারা প্রভাব রাখতে চান, তাদেরও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ব্যাপার আছে। প্রভাব প্রতিপত্তি বলয় জারি রাখার ব্যাপার আছে। আমাদের বিবাদ, আমাদের সমস্যার জন্য কেন অন্যদের কাছে যেতে হবে? কেন আমরা পারছি না? এটা বললে হবে না যে, সব উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে একই বক্তব্য প্রযোজ্য হবে। আজকে মাথাপিছু আয় তিন হাজার ডলারের দিকে যাচ্ছে। সেখানে অন্তত এই জায়গাটা যদি আমরা অতিক্রম করতে পরতাম? বিবাদ, বিতর্ক আছে, মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব আছে, তথাপি এই যে মুখাপেক্ষিতা- সেটা আমার কাছে ভালো ঠেকে না। আমরা কেন যাই? কাজ হয় বলেই যাই বা ভয় পাই বলেই যাই? অথবা মনে করেন, গেলে সুবিধা হবে। এই বাস্তবতা আছে। এটা চট করে নিকটভবিষ্যতে সমাধান হয়ে যাবে তা মনে হচ্ছে না। কবে হবে তা জানি না, তবে দ্রুত হওয়াই ভালো।”
কূটনীতিকদের উপর এই নির্ভরশীলতার বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, “এখন আমরা বিশ্বায়নের পৃথিবীতে বাস করি। একে অপরের উপর পাষ্পরিক নির্ভরশীলতা অনেকদূর। প্রধানত তিনটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত, ভাবমুর্তির ব্যাপারে তারা যদি বলে নির্বাচনটা ভালো হয়েছে, নিরপেক্ষ হয়েছে, সুন্দর হয়েছে, অংশগ্রহণমূলক হয়েছে- তাহলে আমাদের বৈধতার জায়গাটা শক্তিশালী হয়। দ্বিতীয়ত, যেহেতু তাদের সঙ্গে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করি, সেখানে তাদের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে সেটা ভালো হয়। আর তৃতীয়ত, আমরা বিনিয়োগের জন্য বলি। বিনিয়োগ তো সরকার করে না। বেসরকারি উদ্যোক্তারা করেন। আমাদের দেশের সরকারকে যদি ওইসব দেশের সরকার ইতিবাচকভাবে দেখে তাহলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা রেফারেন্স নেয়। এই রেফারেন্সে তারা আগ্রহী হয়। ফলে তিনটা ক্ষেত্রে আমরা পারষ্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্যে আছি।” সূত্র : ডয়েচে ভেলে