চিররঞ্জন সরকার : দেশের জন্য, ফুটবলের জন্য তিনিও কম কিছু করেননি। মহানায়কের গৌরব নিয়েই এ যাত্রাশেষ হওয়ার কথা ছিল তাঁর। তবু জীবন যেমন মাধুর্যময়, তেমনি নিষ্ঠুরও। এমনকিযুধিষ্ঠিরের জন্যও তোলা থাকে নরকদর্শনের নিয়তি।
কথা ছিল শেষ বিশ্বকাপ তিনি ভরিয়ে দেবেন মহানায়কীয় গৌরবে। মাঠজুড়ে ফুল ফোটাবেনতাঁর আশ্চর্য ক্ষমতায়। তিনি বিতর্কিত। একটু বা দুর্বিনীত। খানিকটা বেপরোয়াও। আরহবেন নাই-বা কেন। এই বল্গাহীন ফুটবল-যাপন তো তাঁকেই মানায়, যাঁর নাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কথা ছিল, শেষবার সেই মশালের উজ্জ্বল আলোয় রাঙিয়ে উঠবে ফুটবলের দুনিয়া। অথচ ফুটবল-বিধাতা তাঁর জন্যই বোধ হয় তুলে রেখেছিলেন অন্য কিছু। কোথায়সেই মহানায়কীয় ঐশ্বর্য! কোথায় বা সেই অবিশ্বাস্য স্কিলে মাঠজুড়ে ফুল ফোটানোর বৈভব। বিশ্বকাপের উজ্জ্বল মঞ্চ থেকে বিষণ্ন বিদায় হলো ক্রিস্টিয়ানোর। বিশ্বকাপে একেবারেইছন্দহীন কাটালেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। মাঠে কেবলই নিজের ছায়া হয়ে বিরাজমান‘সিআর সেভেন’! মাঠে অত্যন্ত নিষ্প্রভ লেগেছে তাঁকে।
কাতার বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে রোনালদোকে যখনমাঠে পাঠানো হলো, তখন ঘড়ি বলছে ম্যাচের বয়স ৭৪ মিনিট। গ্যালারিতে প্রবল হর্ষধ্বনি, করতালি, ভক্তদের কানফাটা চিৎকার। পর্তুগাল ততক্ষণে ৫-১ গোলে এগিয়ে। ম্যাচ পকেটেপুরে ফেলেছে। ওই পাঁচটি গোলের সময়েও এত হর্ষধ্বনি শোনা যায়নি গ্যালারি থেকে।গ্যালারির শব্দব্রহ্ম, রোনালদোকে সবুজ গালিচায় দেখার জন্য ভক্তদের আকুতিই বলেদিচ্ছিল, প্রথম একাদশে জায়গা না হলেও, ফার্নান্দো সান্তোসের আস্থা হারালেও, তিনিএখনো ভক্তদের ‘হৃদয়ের রাজা’। এখনো তাঁদের আরাধ্য দেবতা।
কিন্তু মাঠে নেমে তিনি তেমন কিছুই আর করতে পারেননি। পর্তুগাল ছয়-ছয়টি গোল করলঅথচ তাতে রোনালদোর একটা গোলও নেই! স্মরণকালের মধ্যে এমন দৃশ্য তো দেখাইযায়নি।
রোনালদো শুধু তারকা নন। মহাতারকা। বারবার ব্যবহৃত হতে হতে মহাতারকা শব্দটাও হয়তো ক্লিশে হয়ে গেছে। তার থেকেও বড় যদি কোনো বিশেষণ থাকে, তাহলে তিনি তা-ই।গ্রহান্তরের এক শিল্পী ফুটবলার। যেকোনো সময় ম্যাচের গতি-প্রকৃতি বদলে দিতে পারেন।অতীতে বহুবার তার প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু মরক্কোর সঙ্গে শেষ ম্যাচে তিনি পারলেন না।প্রথম একাদশে তিনি না থাকলেও দলের বিপর্যয়ের সময় কোচ কিন্তু তাঁকে নামিয়েছিলেন।তিনি একাধিক সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু তা কাজে লাগাতে পারেননি। তিনি নিজেইনিজের ছায়া হয়ে রইলেন। আর নবাগত মরক্কোর কাছে হেরে দলও বিশ্বকাপ থেকে বিদায়নিল।
রোনালদো একবার তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ‘আমি রেকর্ডের পেছনে ছুটি না, রেকর্ডআমার পেছনে ছোটে।’ এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই। ফুটবল মাঠে তিনি যেন একেকটাগগনচুম্বী অট্টালিকা তৈরি করেছেন। বাকি পৃথিবীর কাছে তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি পাদিয়ে কবিতা লেখেন, তাঁকে ছাড়া জাতীয় দল ভাবাই যায় না! সেই রোনালদোই কিনাসুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাকিদের সঙ্গে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে ম্যাচ দেখলেন! নামলেন ৭৪মিনিটে। শেষ ষোলোর মতো কোয়ার্টার ফাইনালেও তাঁকে শুরুর একাদশে রাখেননি কোচফার্নান্দো সান্তোস। প্রথমার্ধের শেষ দিকে ইউসেফ এন-নেসিরির গোলে পিছিয়ে পড়েপর্তুগাল। ক্যামেরা খুঁজে নেয় বেঞ্চে বসা রোনালদোকে। ডিফেন্ডার আর গোলরক্ষকেরমারাত্মক ভুল দেখেন তিনি অসহায়ের মতো।
৫১তম মিনিটে রুবেন নেভেসের জায়গায় সুযোগ মেলে বদলি নামার। দীর্ঘ দিনের সতীর্থপেপে এগিয়ে এসে পরিয়ে দেন অধিনায়কের আর্ম ব্যান্ড। তিনি মাঠে নামলেন। কিন্তু কোনোকৃতিত্বের ছাপ রাখতে পারলেন না। বলের পেছনে পেছনে দৌড়ালেন। নিজে কোনো সুযোগতৈরি করতে পারলেন না। সতীর্থদের তৈরি করে দেওয়া সুযোগও কাজে লাগাতে পারলেন না।
প্রতিটি বড় সাফল্যের পেছনে থাকে নিদারুণ কোনো ব্যর্থতা। বিদায়বেলায় সেটাই সঙ্গী হলোপর্তুগিজ মহাতারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। তাঁদের বিদায় করে আফ্রিকার প্রথম দলহিসেবে সেমিফাইনালে গেল মরক্কো। অসম্ভব কষ্ট বুকে চেপে, অনেক অপ্রাপ্তির হিসাবমেলাতে মেলাতে চোখের জলে বিশ্বমঞ্চ ছাড়লেন রোনালদো।
রোনালদোর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসি কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁকে ছাপিয়ে গেছেন। মেসিকেরিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রাখার সাহসও দেখাবেন না স্কালোনি। তিনি মাঠে হাঁটছেন, হাঁটতেহাঁটতে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করছেন। অনেকে আবার বলছেন, কোনো মেলায় যেন হেঁটেবেড়াচ্ছেন মেসি! ভক্তরা আশা করেছিলেন, পড়ন্ত বেলায় ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েরোনালদো আবার ফিরবেন ফিনিক্স পাখি হয়ে। সেই অসম্ভবের মহাকাব্য শেষ পর্যন্ত লিখতেপারলেন না তিনি।
অথচ তিনিই তো প্রমাণ করেছিলেন, ভাগ্যের দেখিয়ে দেওয়া পথ নয়; বরং ভাগ্যের দেবতাতাঁকেই বরমাল্য দেয়, যিনি পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য তৈরি করে নিতে জানেন। ক্রিস্টিয়ানোরোনালদো মানেই গোটা বিশ্বের কাছে সেই অদম্য জেদের মন্ত্র। হাল না-ছাড়ার ছড়িয়ে দেওয়াইশতেহার। বিপক্ষের প্রাচীর যত দুর্ভেদ্যই হোক না কেন, তাঁর অতিমানবিক স্কিলের নাগালপাওয়া সম্ভব নয়। ম্যাজিক নয়, তিনি জানেন, শক্তির সাধনায় অটুট প্রাচীর ভাঙার মধ্যেইআছে জীবনের সফলতা। কতবার তো সেই শক্তির কাছেই পরাস্ত হয়েছে কত ডিফেন্সেরসাজানো ঘর।
ফুটবলবিশ্বকে কতবার তিনি দেখিয়েছেন, রেকর্ডের পেছনে নয়, রেকর্ডই তাঁর পেছনে ছোটে।এই রোনালদোকেই ভালোবেসেছে বিশ্ব। যে রোনালদো জানেন পরিশ্রম আর সুযোগ কাজেলাগানোর নামই জীবন। জীবনের জয়গান গাইতে হয় জীবনেরই প্রতিকূলতাকে অতিক্রমকরে। অথচ একটা গোটা বিশ্বকাপ যেন দ্বাদশ ব্যক্তি হয়েই কাটিয়ে দিলেন তিনি।
২০১৬ সাল। সেদিনও তিনি ছিলেন দ্বাদশ ব্যক্তির ভূমিকায়। ইউরো কাপে দলকে টেনেতুলেছিলেন। কিন্তু মোক্ষম দিনে হানা দিল চোট। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন। -চিররঞ্জন সরকার, সাংবাদিক ও লেখক