পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আগামী সপ্তাহে দুটি প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পূর্বাঞ্চলীয় শহর লাহোরে দলীয় সমাবেশে ভাষণে ১৭ ডিসেম্বর তিনি বলেন, আগামী ২৩ ডিসেম্বর পাঞ্জাব ও খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রাদেশিক সরকার আমরা ভেঙে দেব। আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ তৈরির জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।
গত এপ্রিলে সংসদীয় ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি এবার আগাম নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, ইমরানের এই ঘোষণায় চাপে পড়ে যাবে কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ ইমরান খানের অধীনে থাকা দুটি বিধানসভার ভোটসংখ্যা দেশের মোট ভোটারের ৬৬ শতাংশ।
পাকিস্তান সরকার আর্থিক খেলাপিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। তবে তেমন কোনো সফলতা অচিরেই আসছে না। বেড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ইমরান খানের দল দেশটির চারটি প্রাদেশিক পরিষদের মধ্যে দুটিই নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য দুটি তার রাজনৈতিক বিরোধীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যারা প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের অধীনে ফেডারেল সরকারকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
পাঞ্জাব দেশটির সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ। পুরো দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বাস এ প্রদেশে। প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্তির ফলে দেশে নতুন করে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে ফেডারেল এবং প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচন সাধারণত পাঁচ বছর পর পর একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। পাঞ্জাবের নির্বাচনী ইতিহাসে শরিফ পরিবার ছাড়া কেউ দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে এমনটা ভাবা যেত না। প্রদেশটি শরিফ পরিবারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। সেখানে ইমরানের এমন জনপ্রিয়তা কেন্দ্রীয় সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৭ ডিসেম্বরর ওই সমাবেশে পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রীরা ইমরানের পাশে ছিলেন। সেখানে তিনি দুটি প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেওয়ার কথা জানান। ইমরান বলেন, তার দল দুটি প্রাদেশিক পরিষদ ছেড়ে দিয়ে ‘বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইমরান তার কথায় অনড় থাকলে এবং বিরোধীরা যে কারণেই হোক না কেন, তার পদক্ষেপে বাধা দিতে ব্যর্থ হলে গত এপ্রিল থেকে দেশটি যে গুরুতর রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে, তা আরও ঘনীভ‚ত হবে।
যদি দুটি প্রাদেশিক পরিষদ আগেই ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বা কেন্দ্রীয় সরকারের এত বড় পরিসরে নির্বাচনে যাওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। এটি পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে খারাপ করবে এবং দেশটি অর্থনীতি ও রাজনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শাহবাজ সরকার জানিয়েছে, ২০২৩ সালের নভেম্বরের আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না।
প্রসঙ্গত, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অদক্ষতার অভিযোগে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন তার রাজনৈতিক বিরোধীরা। পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরান সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা হাতে নেয় শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক জোট পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। এরপর সময় পেরিয়েছে সাত মাস। এ সময়ে পাকিস্তানের অর্থনীতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। দেশটি এখনো দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পিডিএম বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে এখন সংশয় দেখা গিয়েছে। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশটির জনগণ এখন ক্ষমতাসীনদের ওপর বিরক্ত। দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দিনে দিনে তীব্রতা পাচ্ছে। আর এর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির ময়দানে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছেন ইমরান। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ইমরানের এই পুনরুত্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে দেশটির দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় ইমরানের নজিরবিহীন জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি দেশটির নতুন বাস্তবতাকে নির্দেশ করছে। সেখানে শুধু যে অভ্যন্তরীণ খেলোয়াড়রাই ক্রিয়াশীল এমন নয়; বিদেশিরাও খেলছেন নিজ নিজ স্বার্থে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শরিফ পরিবার যদিও চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রক্ষা করে গেছে; তবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আবার বিলাওয়াল-জারদারির পিপিপি মার্কিনপন্থি বলে পরিচিত। সম্প্রতি ভ‚রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সুস্পষ্ট- একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি, অপরদিকে চীন ও রাশিয়া। উপমহাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আর ইমরান চীনকে কট্টরভাবে সমর্থন দিয়েছেন। তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য দায়ী করছে যুক্তরাষ্ট্রকে। ইমরান আবার ক্ষমতায় এলেও তার অবস্থান একই থাকতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে চীন বর্তমান সরকারের চেয়ে ইমরানকেই বেশি পছন্দ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ২৯ অক্টোবর থেকে লংমার্চ শুরু করেছেন পাকিস্তানের বিরোধী দল পিটিআই। এরপর ৩ নভেম্বর হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন ইমরান খান। একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে জানা যায়। হামলায় ইমরানসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হন। ইমরানের পায়ে গুলি লাগে। এরপরই তিনি বলেছিলেন, দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে তার দল দুটি প্রাদেশিক সরকার থেকে বেরিয়ে আসবে। ইমরানের ওপর হামলার পর শাহবাজ শরিফ বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকারকে নিরাপত্তা ও তদন্তে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
এর আগে গত ১৬ অক্টোবর (রবিবার) গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচনে আটটি জাতীয় পরিষদের আসনের মধ্যে ছয়টি আসনই পেয়েছে ইমরান খানের দল পিটিআই। এ ছয়টি আসনে জিতেছেন ইমরান নিজেই। এই জয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পাঁচ আসনে জেতার নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙলেন ইমরান। ইমরানের আগে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো একসঙ্গে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী চারটি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং একটিতে হেরেছিলেন।
পাকিস্তানে রাজনীতিই শেষ কথা নয়। সামরিক আমলাতন্ত্র সেখানে ক্ষমতাচর্চার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। যে কারণে সেখানে ক্ষমতায় থাকা বা না থাকার বিষয়টি অনেক তবে-কিন্তুর উপর নির্ভরশীল। সামরিক বাহিনীর মার্কিনপন্থি অবস্থানের পরিবর্তন ছাড়া মার্কিনবিরোধী কেউ ক্ষমতায় বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি ইমরান তা করতে চান, তাহলে হয় তাকে মার্কিন প্রশ্নে নমনীয় হতে হবে, তা না হলে গোটা সামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও সামরিক বাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইমরান সদ্যসাবেক সেনাপ্রধান জাভেদ কামার বাজওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শুধু একজন ব্যক্তি দায়ী- জেনারেল (অব.) বাজওয়া। আমাদের শত্রুরা এত ক্ষতি করতে পারেনি, যা তিনি করেছেন। আমি তার বিরুদ্ধে কথা বলিনি। কারণ তিনি সেনাপ্রধান ছিলেন। আমরা চাই আমাদের সেনাবাহিনী শক্তিশালী হোক তাই আমরা চুপচাপ থাকলাম এবং কীভাবে ষড়যন্ত্র হলো তা দেখতে থাকলাম। আমি প্রধানমন্ত্রী ছিলাম; কিন্তু মূল ক্ষমতা ছিল বাজওয়ার হাতে।’ বাজওয়া পিটিআইকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করেছে বলেও ইমরান অভিযোগ করেন।