মতিউর রহমান চৌধুরী: বিশ্বকাপ ফুটবল নিছক কোনো খেলা নয়। এর পেছনে রয়েছে রাজনীতি, কূটনীতি। রয়েছে আবেগ, উন্মাদনা। মিথ্যাচার, শঠতা। পর্দার আড়ালে নানা খেলা। রয়েছে কিছু অপকৌশল। তারপরেও ফুটবল দ্য মোস্ট বিউটিফুল গেম। ১৯৩০ থেকে ২০২২। দেশে দেশে বিশ্বকাপের আয়োজন হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খেলা বন্ধ থেকেছে।
দু’টি দেশ সামরিক যুদ্ধেও অনেকটা জড়িয়ে পড়েছিল। এরপরও ফুটবলের গতি কেউ রুখতে পারেনি। আয়োজক দেশ হবার জন্য বিরামহীন লড়াই চলে। টাকার খেলাও হয়। সমালোচিত হয় ফিফা। ধরা যাক, কাতার বিশ্বকাপের কথা। বারো বছর আগে যখন সিদ্ধান্ত হয় তখন থেকেই কাতার আলোচিত, সমালোচিত। পশ্চিমা গণমাধ্যম শুরু থেকেই এ নিয়ে ফিফাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
কাতারের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কতো টাকায় বিশ্বকাপ বিক্রি হয়েছে এই অভিযোগেও ফিফাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ফিফা বস সেপ ব্লাটার জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত। প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে এক পর্যায়ে তিনি বললেন, কাতারে বিশ্বকাপ দেয়াটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এমন এক সময় তিনি বললেন, যখন বিশ্বকাপ শুরুর প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সমালোচকরা নতুন অস্ত্র পেয়ে গেলেন। তারা আবারও প্রশ্ন তুললেন। এই অবস্থায় কী করে কাতারে বিশ্বকাপ হতে পারে! কিন্তু কাতার নীরব। তারা পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। আয়োজক দেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। ছোট একটি দেশ। এতো বড় আয়োজন কী করে সম্ভব হবে! এটা ঠিক, অঢেল টাকা আছে কাতারের।
কিন্তু শুধু টাকা দিয়েই কি চলে! এজন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা, নেতৃত্ব। কাতার তাতেও দমেনি। বিশ্বকাপ আয়োজনের মাঝপথে ভূ-রাজনীতির শিকার হয় দেশটি। কাতারের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অবরোধ চলাকালে নতুন করে সংশয় তৈরি হয়। এটাও ব্যর্থ হয় কাতারের বিরামহীন দূতিয়ালিতে। ষড়যন্ত্র ছিল কাতারে যাতে বিশ্বকাপ না হয়। কাতারের নেতৃত্ব সেটা জানতেন। হতাশা ছিল, কিন্তু আয়োজনের গতি শ্লথ হয়নি। মানবাধিকারের প্রশ্নটিও আনা হয়েছিল সামনে। শেষে যোগ হলো সমকামিতা। অ্যালকোহল নিয়ে তো ঝড় উঠলো। কাতারি নেতৃত্ব অনড়। এসব বিষয়ে কোনো আপস নয়। ১৭ ঘণ্টা আগে যখন অ্যালকোহল বন্ধ করার কঠিন এই সিদ্ধান্তটি এলো তখন শুরু হয়ে গেল নেতিবাচক প্রচারণা, কূটকৌশল।
এ নিয়ে এখন রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে কেন কাতারি নেতৃত্ব শেষ মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত নিলেন। নানাভাবে যেটুকু জানা গেছে, তাতে ধারণা করা যায় নিরাপত্তা নিয়ে হুমকি ছিল। এমনকি কাতারিদের মধ্যেও সংশয় ছিল অ্যালকোহল অ্যালাও করলে দেশটির ঐতিহ্য ধুলোয় মিশে যাবে। সমাজে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানি যখন এই সিদ্ধান্তটা দেন তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন শেষ অব্দি পশ্চিমা ফুটবলভক্তরা হয়তো টিকিট বাতিল করবেন।
এগুলো ছিল অনুমান, ধারণা। বাস্তবে দেখা গেল জনস্রোত আটকানো যাচ্ছে না। কেউ কেউ নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন- লাখ লাখ ফুটবলভক্ত আসছেন, সুযোগ নিতে পারে অপরাধীরা। বিচ্ছিন্ন দু’-একটি ঘটনা ছাড়া তেমন কিছু ঘটেনি। নিরাপত্তা চলেছে কম্পিউটারের মতো। পুরো দেশটি ছিল সিসি টিভি’র ক্যামেরায়। একজন আর্জেন্টাইন সাংবাদিকের কিছু জিনিসপত্র চুরি হয়েছিল। তার অভিযোগ শুনে নিরাপত্তাকর্মীরা বলেছিলেন, অপেক্ষা করুন। ঠিকই জিনিসপত্র আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই সাংবাদিক যখন তার হারানো জিনিসপত্র ফিরে পেলেন তখন তিনি হতবাক, বিস্মিত! এ তো মনে হয় ম্যাজিক! নিরাপত্তাকর্মীরা ওই সাংবাদিকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন আপনি কী ধরনের শাস্তি চান। জবাবে সাংবাদিক বললেন, তোমাদের দেশের কানুন অনুযায়ী যা হয় তাই হোক। ভাবা যায়! এরকম ঘটনাও ঘটে!
ফ্যানজোনগুলোতে হাজার হাজার মানুষের বিচরণ ছিল। সরব ছিলেন অগণিত ফ্যান রাত-বিরাত কোথাও কোনো ঝামেলার কথা শোনা যায়নি। উগ্র পোশাক-আশাক যে ছিল না তা কিন্তু নয়। তাতেও নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি ছিল না। রাত তিনটা-চারটার দিকে মেট্রোরেলে ফিরেছি। ভয়ের সংস্কৃতি আমাকে কাবু করেনি। খেলা শেষে হাজার হাজার ফ্যানকে নিয়ন্ত্রণ করাও ছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা। জাপানিরা গ্যালারি পরিষ্কার করেছেন। বাইরে নিরাপত্তাকর্মীরা ছিলেন তৎপর। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ফাঁকফোকর ছিল না। বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল ভলান্টিয়ার। যারা ছিলেন এই বিশ্বকাপের বাড়তি আকর্ষণ। বিনিময়ে তাদেরকে যে খুব একটা টাকা দেয়া হয়েছে তা কিন্তু নয়। আরব দুনিয়ার অনেকেই বাঁকা চোখে দেখছিলেন। কাতারকে কোণঠাসা করাই ছিল তাদের অঘোষিত কৌশল। আরব নেতারাই এখন বলছেন, বিশ্বকাপ আমাদের গর্বের উৎস। তারাই তো একদিন বলেছিলেন, কাতারে বিশ্বকাপ হলে আরব সংস্কৃতির মৃত্যু হবে। অ্যালকোহলে, উদ্দাম নৃত্যে ভেসে যাবে কাতার। তাদের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ অমূলক। কাতারে এর ছিটেফোঁটাও লাগেনি। দেশটি এখন অভিনন্দন বার্তায় ভাসছে।
আয়োজনে তেমন কোনো ত্রুটি ছিল না। স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে শোকেসে রাখার মতো। মেট্রোরেল না হলে হয়তো নানা প্রশ্ন উঠতো। আমার কেন যেন মনে হয়, মেট্রোরেল না হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ত্রুটি থেকে যেত। বাস চলেছে বিরামহীনভাবে। এর জন্য কোনো পয়সা লাগেনি। এয়ারপোর্ট ব্যবস্থাপনা ছিল নিখুঁত। কোনো ঝামেলা বা হয়রানির খবর নেই। তবে হোটেল নিয়ন্ত্রণে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যে কারণে অনেকেই আসার সুযোগ পাননি। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। যাইহোক, শেষ অব্দি এই সংকটেরও সমাধান হয়েছে। ফ্যানজোনগুলো ছিল আরেক বিস্ময়। স্যুক ওয়াকিফ পরিণত হয়েছিল এক মিলনমেলায়। লাখ লাখ ফুটবলভক্তের আগমনে মুখরিত ছিল দিনরাত। এই সুযোগে অবশ্য হোটেল মালিকরা দু’পয়সা কামিয়ে নিয়েছেন। স্যুক ওয়াকিফে কী আছে? একশ’ বছরের পুরনো মার্কেট এমনভাবে তৈরি- আপনি সহজে ওখান থেকে বের হতে পারবেন না- এমন আঁকাবাঁকা। ফ্যানরা মেতে থাকতেন গানবাজনায়।
দুটো খেলা বাকি। রোববার চূড়ান্ত লড়াই। কে জিতবেন? মেসি না এমবাপ্পে? রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পুরনো ইতিহাস টেনে এনে কোনো অঙ্ক মিলবে না। ৭১ পার্সেন্ট বল নিয়ন্ত্রণে রেখেও মরক্কোকে পরাজয় মানতে হয়েছে। অভিজ্ঞতার ঘাটতি এবং অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস তাদের স্বপ্নকে থামিয়ে দিয়েছে। এই বিশ্বকাপে অনেক নাটকীয়তা ছিল। অনেক অঘটনেরও জন্ম দিয়েছে। কেউ মানুন আর না মানুন, বিশ্বকাপ আয়োজনকে কাতার যে উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে তা অন্যদের জন্য মস্তবড় এক চ্যালেঞ্জ। ছ’টা বিশ্বকাপ কাভার করে আমার এই ধারণাই হয়েছে।-দৈনিক মানবমজমিন এর সৌজন্যে