একই সঙ্গে পণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এতে টাকার হাতবদল কমে যাচ্ছে। যে কারণে প্রবৃদ্ধির হারও কমবে। যুগান্তরের সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব কথা বলেছেন দেশের তিন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ-সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আরও এক দফা কমিয়েছে। এডিবির হিসাবে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। ৬ মাসের মধ্যে তারা জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে বলেছে, চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে তারা বলেছিল প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে। এদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে গত অক্টোবরে বলেছে, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। তবে এপ্রিলে তারা প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাতে পারে। এদিকে সরকার থেকে চলতি অর্থবছরের শুরুতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। ইতোমধ্যে সরকার এ হার ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করেছে।
সব সংস্থা থেকেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সরকার থেকেও এ হার বাড়ানো হয়েছে। গত বছরের জুনে সরকার মূল্যস্ফীতির হার ধরেছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এখন তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করেছে। মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এতে এডিবি ও বিশ্বব্যাংক মনে করে চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে থাকতে পারে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বিষয়ে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেকটা জোরালোভাবে আঘাত হেনেছে। এর প্রভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সঙ্গতকারণে কমেছে চাহিদাও।
এতে পণ্য বিক্রি কমেছে। একই কারণে বৈশ্বিক মন্দায় বিদেশের বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। ফলে রপ্তানির অর্ডার যেমন কমেছে, তেমনি আয়ও কমছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় এক দিকে রিজার্ভ কমছে। অন্যদিকে ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে টাকার মান কমে গেছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এ কারণে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে।
জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও দাম বৃদ্ধি শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উৎপাদন কমার পাশাপাশি খরচ বেড়েছে। এতে বেড়েছে পণ্যের দাম। একদিকে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, অপরদিকে ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া-এ দুইয়ে মিলে মানুষ চাপে পড়ে পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে জিডিপিকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নিতে হবে-ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে হিসাব দিয়েছে তা ঠিকই আছে। তাদের হিসাব বাস্তবতার কাছাকাছি রয়েছে। প্রবৃদ্ধি কোনো ক্রমেই ৫ দশমিক ২ শতাংশ বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি হবে না। সরকার প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশ অর্জিত হবে বলে যে হিসাব দিয়েছে এটি অর্জন করা কঠিন।
দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি হবে না। বৈশ্বিক মন্দা ও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি যে কমবে এটি সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে কত কমবে সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। আমিও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের সামান্য বেশি হতে পারে। এর চেয়ে বেশি হবে না। প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর অন্যতম প্রধান উপকরণ রপ্তানি আয়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নিম্নমুখী।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ খুব বেশি বাড়ছে না। ডলারের হিসাবে এটি কমছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন কমে গেছে। এখন শুধু কৃষি খাত উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। কিন্তু কৃষির ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বেসরকারি খাতকে সমানভাবে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। এই তিনটি খাতই এখন এগোচ্ছে না।
ছোট উদ্যোক্তাদের অবস্থা আরও খারাপ। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, সেটি অর্জিত হলেই সন্তোষজনক বলা যায়। ভারতে হয়তো কিছু বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। এটি ৬ শতাংশের সামান্য বেশি হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে সরকারকে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হলেও তেমন কোনো সমস্যা নেই। প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পায় না। শুধু উচ্চ আয়ের মানুষ প্রবৃদ্ধির সুফল বেশি পায়। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে এর সুফল যাচ্ছে না। ফলে তারা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন চড়া মূল্যস্ফীতির কারণে বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ বেশি কষ্ট ভোগ করছে। তাদের মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সহনীয় রাখতে এ হার কমাতে হবে। এটি কমানোর জন্য দরিদ্র মানুষের মধ্যে কম মূল্যে খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। তাদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরি।
শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করতে হবে-ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ :
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছে এটি তাদের নিজস্ব হিসাব। প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করেছে, সেটি অর্জন করাও বেশ কঠিন। কারণ সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশে নেই।
চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ঘুরেফিরে ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ গত কয়েক বছর ধরে দেশে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। ফলে নতুন শিল্প হচ্ছে না। আগে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়লেও এখন সেগুলো নিম্নমুখী।
প্রবৃদ্ধির হার কমার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রধান উপকরণগুলোর মধ্যে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বিনিয়োগ, ঋণপ্রবাহ, আমদানি, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বাড়তে হবে। মানুষের আয় বৃদ্ধি করে পণ্য কেনার চাহিদা বাড়াতে হবে। তাহলে মানুষের চাহিদা বাড়বে।
এতে উদ্যোক্তারা উৎপাদন বাড়াবে। ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। কিন্তু বর্তমানে এসব খাতে নিম্নমুখী প্রবণতা বিরাজ করছে। শুধু কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এখনও কৃষক পণ্যের নায্যমূল্য পাচ্ছে না। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমার কারণে একদিকে রিজার্ভে চাপ বেড়েছে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স ভোগীদের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে।
রপ্তানি আয় কমায় রিজার্ভে চাপ বেড়েছে, একই সঙ্গে রপ্তানিকারকদের কাছে তারল্যের প্রবাহ কমে যাবে। ফলে তারা উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারবে না। এ খাতের শ্রমিক কর্মীদের মধ্যেও টাকার প্রবাহ কমবে। সব মিলে টাকার প্রবাহে নিম্নমুখিতা রয়েছে। বেসরকারি খাতের কর্মকাণ্ডও বলতে গেলে স্থবির। ডলার সংকটে এলসি খোলা যাচ্ছে না। আমদানি কমে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় কম পণ্য আসছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কমে গেছে। কাঁচামালের অভাবে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, শিল্পের জন্য গ্যাস, বিদ্যুতের সংকট এখন প্রকট। ডলার সংকটে এগুলো আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে শিল্পের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যে করেই হোক ডলার সংস্থান করে শিল্পে গ্যাস ও বিদ্যুতের জোগান বাড়াতে হবে। তা না হলে এ খাতে বিপর্যয় নামলে তা অর্থনীতির জন্য বড় শঙ্কার কারণ হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, তবে আগামী বছর প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হতে পারে। কারণ দীর্ঘ সময় ধরে মন্দা চলার কারণে হঠাৎ প্রবৃদ্ধি বেশি বাড়ানো সম্ভব হবে না।
ডলার সংকটে আমদানি কমে গেছে-ড. জাহিদ হোসেন : বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কমবে, এটি নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সবাই একমত যে প্রবৃদ্ধি কমবে। এখন কত কমবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ২ শতাংশ হবে, এডিবি বলেছে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। সরকারও প্রবৃদ্ধির হার কমিয়েছে। তারা সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করেছে। প্রবৃদ্ধির হার কমার পেছনের নেপথ্য কারণগুলো হচ্ছে, বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এতে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। ফলে উৎপাদনের পাশাপাশি সরবরাহও কমেছে। ফলে টাকার হাতবদলও কমে গেছে। টাকার হাতবদল যত কমবে প্রবৃদ্ধিও তত কমবে। কারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির থাকলে টাকার হাতবদল কমে যায়। মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়। এতে টাকা সবাই ধরে রাখতে চায়। কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না বা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে চায় না।
একই সঙ্গে ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমে গেছে। এতে শিল্পের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক পণ্যের বাজারেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কাঁচামাল আমদানির অভাবে বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট তো আছেই। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শিল্প খাতেও টাকা ঘুরছে না। ব্যাংক থেকে টাকা বের হয়ে শিল্প খাত ঘুরে মানুষের হাতে পৌঁছে। এখন শিল্প খাতে স্থবিরতার কারণে টাকার হাতবদল কম হচ্ছে। এতে প্রবৃদ্ধির চাকাও ধীরগতিতে ঘুরছে। যে কারণে প্রবৃদ্ধি কম হবে।
তিনি আরও বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় পণ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। খেয়াল করলে দেখবেন, ইফতারির বাজারেও বিক্রি কম। মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। সংকটের কারণে মানুষের চাহিদায় পবির্তন এসেছে। চাহিদা কাটছাঁট করা হয়েছে। একেবারে অপরিহার্য ছাড়া অন্য কোনো কেনাকাটা করছে না। আর কেনাকাটা করার সক্ষমতাও অনেকে হারিয়ে ফেলেছে। এতে প্রবৃদ্ধি কমবে। সূত্র : যুগান্তর