বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেছেন, গণতন্ত্রের জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন জরুরি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যাতে এ দেশের জনগণ তাদের পছন্দের সরকার বেছে নেওয়ার সুযোগ পান। যুক্তরাষ্ট্র কোনো একটি দলকে সমর্থন করে না বলে জানান এ রাষ্ট্রদূত।
যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পিটার হাস বলেন, বাংলাদেশে ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং রাজনৈতিক সহিংসতার খবর আমরা লক্ষ্য করেছি। এসব অস্বস্তিকর। কারণ, রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। আমরা সবাইকে আইনের শাসন মেনে চলা এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। সাংবাদিকরা যেন অবাধে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের হয়রানি ও সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দিতে হবে।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এতে র্যাবের ওপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা, জিএসপি সুবিধা, শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা, সামরিক সহযোগিতা, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের নানা সুযোগ-সুবিধাসহ সার্বিক বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন পিটার হাস। নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
যুগান্তর : বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পারস্পরিক বন্ধুত্বকে খুবই মূল্য দেয় এই দুই দেশ। সম্পর্কের ৫০ বছর অতিবাহিত হচ্ছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন কতটা হয়েছে বলে মনে করেন? দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথ কোনদিকে অগ্রসর হচ্ছে?
পিটার হাস : স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশ যে সত্যিকার, বাস্তব এবং প্রকৃত অর্থে যে অগ্রগতি ও উন্নতি করেছে, তা দেখে আমি অভিভূত। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশের জিডিপি ১৯৭২ সালের তুলনায় ৫০ গুণ বড় হয়েছে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের থেকে উত্তরণ ঘটাতে যাচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে এটা একটা স্থিরভাবে অগ্রগতি অর্জন।
যুক্তরাষ্ট্র এই উন্নয়নের পথে অংশ হতে পেরে গর্বিত। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ৮০০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে। প্রতিবছর আমরা ২০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তন খাতে দেওয়া হচ্ছে এই সহায়তা। এই কর্মসূচি বাংলাদেশের জনগণকে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে।
আরও খবর। ইউক্রেনে থাকা বাংলাদেশিদের পোল্যান্ড দূতাবাসে যোগাযোগের আহ্বান
আগামী ৫০ বছরে আমাদের অংশীদারত্ব আরও জোরদার হবে। এটার ভিত্তি হবে আমাদের অংশীদারত্বমূলক অর্থনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে। খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য কমানোসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, এই ধারা অব্যাহত রাখব। জলবায়ু পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির উন্নয়ন, বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন ও উদ্ভাবনিমূলক দৃষ্টিও প্রসারিত করব। আমাদের একত্রিত ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে আমি খুবই উচ্চ আশা পোষণ করি।
যুগান্তর : দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে টেকসই করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৃহত্তর বাণিজ্য, বিনিয়োগ প্রবাহ, প্রযুক্তির হস্তান্তর, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই, অভিজ্ঞতা বিনিময়, উন্নয়ন দক্ষতার জন্যে বাংলাদেশ অবশ্যই সহায়তার জন্য আহ্বান জানায়। এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে দুদেশ কীভাবে সহায়তা করতে পারে?
পিটার হাস : যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের সবচেয়ে বড় সুযোগ হলো বাণিজ্য বৃদ্ধি করা। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে লাভবান হওয়ার সুযোগ দীর্ঘদিন ধরেই দেখতে পাচ্ছে। বাংলাদেশের আকর্ষণীয় ও স্থিরভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নতির কারণে আমেরিকার কোম্পানিগুলো এ দেশে অধিক বিনিয়োগ করতে চায়।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে আরও বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আমেরিকান কোম্পানিগুলো স্বীকার করে যে, বাংলাদেশে টেকসই জ্বালানিসহ জ্বালানি খাত, ডিজিটাল ইকোনমি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং হালকা শিল্প খাতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের সাফল্য বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে দেশটিকে মূল চালিকা শক্তি হিসাবে পরিগণিত করেছে। এক্ষেত্রে, বৈচিত্র্যপূর্ণ, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য সরবরাহ চেইনকে অগ্রাধিকার কাম্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নেতৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশংসা করে। এই সমস্যা সমাধানে দেশটিকে গর্বিত অংশীদার মনে করে। ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। তার অতিরিক্ত হিসাবে ইউএসএআইডি’র মাধ্যমে চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশের বনভূমি ও নিম্নাঞ্চলকে সুরক্ষার লক্ষ্যে দুই কোটি ডলারের প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এই অর্থ থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলার বিষয়ে সহায়তা দেওয়া হবে।
যুগান্তর : বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার অন্যতম মূল ক্ষেত্র হলো নিরাপত্তা খাত। দুদেশের মধ্যে নিয়মিত নিরাপত্তা সংলাপ রয়েছে। এই নিরাপত্তা সংলাপের অধীনে কী কী ক্ষেত্রে সহায়তা নিয়ে আলোচনা করা হয়? যুক্তরাষ্ট্র অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা) এবং জেনারেল সিকিউরিটি অব মিডলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেনন্ট (জিসোমিয়া), লেহি আইনসহ বেশকিছু চুক্তির প্রস্তাব করেছে। এ সব প্রস্তাবিত দলিলের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা? অস্ত্র চুক্তির কোনো প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে কি? বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তার কোনো প্রস্তাব কি যুক্তরাষ্ট্রের আছে?
পিটার হাস : বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা সংলাপে বিস্তৃত ইস্যুতে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এসবের মধ্যে আছে প্রশিক্ষণ, অনুশীলন, বিনিময়, সরঞ্জাম এবং পারস্পরিক স্বার্থ যেমন শান্তিরক্ষা কার্যক্রম এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রভৃতি।
আমরা বিশ্বাস করি, জিসোমিয়া ও আকসা প্রতিষ্ঠা হলে আমাদের উভয় দেশ উপকৃত হবে। এই চুক্তিগুলো দেখতে জটিল মনে হলেও বাস্তবে খুবই সহজ। জিসোমিয়ার ফলে পরস্পরের স্পর্শকাতর সামরিক তথ্য বিনিময় ও সুরক্ষার ভিত্তির নিয়মনীতি দেবে। এটা বোঝা জরুরি যে, জিসোমিয়া বাংলাদেশ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রকে স্পর্শকাতর সামরিক তথ্য দিতে বাধ্য করবে না। বরং সামরিক তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশ উপকৃত হবে। এটা তথ্যের সুরক্ষা কীভাবে হবে তার চুক্তি। সামরিক তথ্যের মধ্যে কতিপয় প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি যার মধ্যে সামরিক অভিযানের কলাকৌশলও অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে আমাদের দুদেশের মধ্যে জিসোমিয়া চুক্তি না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এয়ারক্রাফট ও এ সংক্রান্ত অস্ত্রসহ অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয়ে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আকসা সমুদ্রে আমাদের পরস্পরের সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। যখন কোনো এয়ারক্রাফট কিংবা পরিবহণ কিংবা জাহাজ সমস্যায় পড়বে তখন সরঞ্জাম কিংবা স্পেয়ার পার্টস ধার দিতে পারবে। কিংবা জ্বালানি অথবা খাদ্য বিনিময় করতে পারবে। আমরা যখন বঙ্গোপসাগরে যৌথভাবে মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করব; তখন এই চুক্তি খুবই কার্যকর হবে।
এই ভিত্তিমূলক চুক্তিগুলো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করবে। বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা লক্ষ্য অর্জনে অনেক বেশি বিকল্প সুবিধা দেবে। জিসোমিয়া কিংবা আকসা কোনোটাই ‘অ্যালয়েন্স’ কিংবা ‘সামরিক চুক্তি’ নয়। এগুলো অতি সাধারণ চুক্তি। বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশ আমাদের সঙ্গে এই চুক্তি সম্পাদন করেছে।
লেহি আইন সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তির কোনো প্রস্তাব বাংলাদেশের কাছে দেয়নি। বরং লেহি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইন। বিশ্বের যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে সবার ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই আইন প্রযোজ্য। লেহি আইনের লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের তহবিলের অর্থ ওই সব নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য ব্যবহার না করা যেসব বাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বলে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো অস্ত্র চুক্তির প্রস্তাব করেনি। বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোনো অংশীদারের সঙ্গে আমরা যেভাবে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা করে থাকি এটা তেমন কোনো পথ নয়। বরং আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সংলাপে বসি। প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বাড়াতে বাংলাদেশের অনুরোধ শুনি। আমরা তখন নির্ধারণ করি, এ ধরনের অনুরোধ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব কিনা। আমরা কোনো ঋণ প্রস্তাব করি না। তার বদলে বাংলাদেশ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রতিরক্ষাসামগ্রী ক্রয় করে। কিংবা প্রতিরক্ষাসামগ্রী ক্রয় করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মঞ্জুরি সহায়তা হিসাবে অর্থ দিয়ে থাকে। ফরেন মিলিটারি ফাইন্যান্সিং এবং গ্লোবাল পিস কিপিং অপারেশনস ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচির আওতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। এই তহবিল অস্ত্র, মেরিটাইম পেট্রোল ক্রাফট, ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস মোকাবিলায় সরঞ্জাম, নাইট ভিশন ডিভাইস দিয়েছে। এই কর্মসূচি বাংলাদেশকে দ্রুততম সময়ে মনুষ্যহীন এরিয়াল সিস্টেম উন্নয়নে সহায়ক হবে। এটা বাংলাদেশকে শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং মেরিটাইম সিকিউরিটি অপারেশন উভয় ক্ষেত্রে সহায়তা দেবে। তার অতিরিক্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক্সসেস ডিফেন্স আর্টিক্যাল প্রোগ্রামসের অধীনে পারস্পরিক স্বার্থে বাংলাদেশকে দুটি কাটার জাহাজ এবং ৫০টি অ্যামবুশ প্রতিরোধক যানবাহন ক্রয় করতে পেরেছে। এই কর্মসূচি সীমাহীন প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বৃদ্ধির উৎস না হলেও বাংলাদেশের মূল নিরাপত্তা প্রয়োজন মেটাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা সচেষ্ট থাকে। তার মধ্যে আপনার প্রশ্নে উল্লেখ মোতাবেক বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত।
যুগান্তর : বর্তমান ও সাবেক র্যাব কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ অনুরোধ জানিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা? এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে একত্রে কাজ করবে?
পিটার হাস : প্রেসিডেন্ট বাইডেন মানবাধিকারের প্রতি গভীরভাবে যত্ন নিয়ে থাকেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে এটিকে স্থাপন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী। এই লঙ্ঘন কোথায় এবং কখন ঘটেছে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়।
নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত বিষয়ের জন্য প্রধান এজেন্সি হলো যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয় ওই বিভাগই বিবেচনা করবে। তবে এ ব্যাপারে জবাবদিহিতা ও পরিবর্তন অবশ্যই হতে হবে।
নিষেধাজ্ঞা আমাদের সম্পর্ক কিংবা সহযোগিতাকে সীমাবদ্ধ করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে বিস্তৃত সম্পর্ক। বাণিজ্য, উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে রয়েছে গভীর সহযোগিতা।
যুগান্তর : যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই চাইছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যমান জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি?
পিটার হাস : আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকারের অভাবে ২০১৩ সালে ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ বাংলাদেশের জন্য ইউএস জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা স্থগিত করে। টার্গেটেড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্সসহ শ্রম অধিকার উন্নয়নে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর।
যুগান্তর : প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) ঘোষণা করেছেন। এই ব্লকে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা? বাংলাদেশকে এতে যোগ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করেছেন কি?
পিটার হাস : সম্প্রতি চালু হওয়া ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কের তথা আইপিইএফ’র ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। মার্চে অংশীদারত্ব সংলাপের পর থেকে ঢাকা ও ওয়াশিংটনে এই যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। বর্তমানে ১৪টি প্রাথমিক আইপিইএফ অংশীদার চারটি ভিত্তির ওপর আলোচনা করছে। এসব ভিত্তি হলো, বাণিজ্য, সরবরাহ চেইন, পরিচ্ছন্ন অর্থনীতি (পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, কার্বন কমানো এবং অবকাঠামো) এবং অবাধ অর্থনীতি (কর ও দুর্নীতি দমন)। আইপিইএফ’র মাধ্যমে অংশীদারদের লক্ষ্য হলো, আঞ্চলিক সহযোগিতা, স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং শান্তি। গোটা অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিনিয়োগ, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন, কর্মী ও ভোক্তাদের বাস্তবে লাভবান করবে। আলোচনা চলাকালে অংশীদার দেশগুলো এ গ্রুপের সম্প্রসারণের বিষয়ে আলোচনা করবে। আমরা বাংলাদেশকে এক কিংবা একাধিক ভিত্তির ওপর সম্ভাব্য অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করছি।
যুগান্তর : বাংলাদেশ আগামী সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অপরাপর পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচনের গুণগত মান নিয়ে সমালোচনা করে থাকে। আপনারা বাংলাদেশের মানবাধিকার, সুশাসন, শ্রম অধিকারের রেকর্ড নিয়েও সমালোচনা করেন। বাংলাদেশ সরকার মনে করে, এভাবে প্রকাশ্যে সমালোচনা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা, মানবাধিকার, শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতির গুণগতমানের উন্নয়নে আপনাদের কোনো সুনির্দিষ্ট সুপারিশ আছে কি? বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সমর্থন দেবে?
পিটার হাস : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদীয় নির্বাচন করতে চায়। আমরা এ শব্দমালাকে স্বাগত জানাই। সরকার কীভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। নির্বাচনের পূর্বে বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে গঠনমূলক পদক্ষেপকে আমরা সমর্থন করি।
যে কোনো সত্যিকার গণতন্ত্রের জন্যে অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন জরুরি বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে। বাংলাদেশের নির্বাচন কিংবা যে কোনো স্থানের নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদের নীতি হলো সে দেশে আন্তর্জাতিকমানের নির্বাচন হবে-যাতে সে দেশের জনগণ তাদের সরকার বেছে নেওয়ার সুযোগ পান। আমরা কোনো একটি দলকে সমর্থন করি না।
বাংলাদেশে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতার খবর আমরা লক্ষ্য করেছি। এসব খবর অস্বস্তিকর। কারণ, রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। আমরা সবাইকে আইনের শাসন মেনে চলা এবং সহিংসতা, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। সাংবাদিকরা যেন অবাধে এবং সম্পূর্ণভাবে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করতে পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের হয়রানি ও সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। শ্রম অধিকার সম্পর্কে বলতে চাই, বাংলাদেশে শ্রম আইন সংশোধনে প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু এখনও শ্রমিকরা দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে তারা নানা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সূত্র : যুগান্তর