নিউইয়র্ক     সোমবার, ৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২২শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ কামরুল

আড্ডা উবাচ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৩ | ০২:৪১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩ | ০২:৪১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
আড্ডা উবাচ

জোয়ার জলের মতো আবেগ যখন দোলে মনোতটে, মন-প্লাবন অথৈ কথা মুখিয়ে ওঠে। একা একা অন্তর্গত মনোলগ করা যায়, সলিলক্যি করা যায়, তাতে উজাড় করা যায় না মন। তার জন্য লাগে শ্রোতা, লাগে মিথস্ক্রিয়া। একা একা ইন্টেলেকচুয়ালিঋদ্ধিমান বনে যাওয়া যায় কিন্তু একা একা ইন্টেলেকচুয়ালি ইগনাইটেড হওয়া যায় না। তার জন্যে লাগে শ্রোতা। লাগেমিথস্ক্রিয়া। আর সেখানেই প্রয়োজন হয় আড্ডার। আড্ডা সঙ্গী যে কোন মাপের ও উচ্চতার হলেই কিন্তু আড্ডা জমে ওঠে না।চাই সিঙ্ক করবার মতো সমসত্ত্বতা বা হোমোজিনিয়িটি।

আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে আড্ডায় সময়ের অপচয় হচ্ছে। সেটা নির্ভর করে কার সঙ্গে কোন বিষয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। আড্ডাকিন্তু প্লেটোর আকাদেমির চাইতেও বড় বিশ্ববিদ্যালয় যেখান থেকে আহরণ করা যায় দুনিয়াদারীর সারনির্যাস। সক্রেটিসেরযিনোফন সক্রেটিসের সঙ্গে এক ধরণের আড্ডা থেকেই তার মেমোরিবিলিয়ার একটা ভল্যুম সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেনবিশেষভাবে।

বুদ্ধদেব বসু ‘আড্ডা’ প্রবন্ধে কহেন, “ ছেলেবেলা থেকে এই আডডার প্ৰেমে আমি মজে আছি। সভায় যেতে আমার বুক কাঁপে, পাটির নামে দৌড়ে পালাই, কিন্তু আড্ডা। ও না-হ’লে আমি বাঁচি না। বলতে গেলে ওরই হাতে আমি মানুষ। বই পড়ে যা শিখেছিতার চেয়ে বেশি শিখেছি আড্ডা দিয়ে। বিশ্ববিদ্যাবৃক্ষের উচ্চশাখা থেকে আপাতরমণীয় ফলগুলি একটু সহজেই পেড়েছিলুম—সেটা আড্ডারই উপহার। আমার সাহিত্যরচনায় প্রধান নির্ভর রূপেও আড্ডাকে বরণ করি। ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশঙ্কাকরেছিলেন যে আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি ওতে আমার সর্বলাভ হ’লো।“

আড্ডার ল্যান্ডস্কেপ একটা পাবলিক-আর্ট। আড্ডার বুনন নিপুন না হলে, আড্ডার মুখগুলো সিলেক্টিভ না হলে আড্ডারইকোলজি দূষিত হয়ে পড়ে। অসমসত্ত্ব আড্ডাবাজের আড্ডা ক্ষতিগ্রস্থ হয় আড্ডা-দূষণে। আমাদের আড্ডা প্রায়শঃই তেমনি।আমাদের আড্ডা “পরস্পরের চুলকে পিঠ মারবো মক্ষী মারবো কীট” প্রেরণার আড্ডা। বুব এর আড্ডা বন্দনার উল্টো কথাবলতে হয়, আমাদের আড্ডায় সর্বনাশ হয়।

আমার আড্ডাদিনের শুরুটা ছিল কবি কর্নার টেবিলে। খুলনা পিকচার প্যালেস সিনেমা হলের উল্টোদিকে হোটেল ডিলাক্সেরএকটা ডাবল সোফাসেট টেবিলের নাম দিয়েছিলাম কবি কর্নার। সেটা ছিল আমাদের সাহিত্য আড্ডা ডোমেইন।

কবি কর্নার ছিল একটা গেটওয়ে বা তোরণের মতো। সেই তোরণের ভিতর দিয়ে কবি কর্নার টেবিলে এসে বসতো কাব্যপ্রেমীতরুণেরা। সুন্দরবনের কোল ঘেষা গ্রাম ঈশ্বরীপুর থেকে এসেছিল জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। কয়েক মাস খুলনায় ছিলেন জয়ন্ত দা।দুরন্ত ক্লাসিক আড্ডা হয়েছিল। আমার মহাভারত, রামায়ণ জানার শুরুটা জয়ন্ত দা’র কাছ থেকে। তারপর একদিন পাহাড়েরমতো এসে দাঁড়ালো কবি হাফিজুর রহমান। হাফিজ পরে যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিল। কবিতার ছন্দ নিয়ে হাফিজুররহমান বেশ টানটান ছিল। রুদ্র ঢাকা থেকে মিঠেখালি যাওয়ার পথে আর ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পথে শহিদ হাদিস পার্কেরদেয়ালের উল্টোদিকে ওর ফার্স্ট কাজিন জগলুলের বাসায় দুদিন থাকতো। কবি কর্নারে বেশিক্ষণ থাকতে চাইতো না রুদ্র। ওরঝোলায় থাকতো প্রিয় সঙ্গী হিপ-পকেটএবল কেরুর পাইট। কাস্টমস ঘাটে ভৈরব মোহনা মোড়ে কেরুর সঙ্গে আমাদের প্রথমপরিচয় ঘটেছিল রুদ্র’র হাত ধরে। রুদ্র ছিল আমাদের সাকি।

তখন রুদ্র’র প্রথম বই উপদ্রুত উপকূল বের হচ্ছিল। আমার মতামত চেয়েছিল পান্ডুলিপি পড়তে দিয়ে। বলেছিলাম, জসিমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম, আল মাহমুদের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে না, বেরিয়ে এসে তুমি হয়ে যাও।

কবি কর্নারে আমার জায়গা শক্ত হচ্ছিল না যদিও আমি সেখানে ঢুকেছিলাম যশোর বোর্ডের সিক্সথ স্ট্যান্ড রেজাল্ট নিয়ে।জায়গা করে নিতে বিশ্ব সাহিত্যে আমার যে ব্যুৎপত্তি ছিল তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে নিলাম। সেই জানাশোনার হোসপাইপ খুলে দিয়ে, বকবক প্রকট করে আড্ডা-সতীর্থদেরকে তার প্রভাবাধীন করে ফেলেছিলাম সহজেই। আমার আড্ডা সতীর্থরা বিশ্ব সাহিত্যসম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না। আমার এই কায়দাটা পরে সাপ্তাহিক রোববারের সম্পাদক রফিক আজাদের টেবিলে বার কয়েকবসে বুঝতে দেখেছিলাম। রফিক ভাই সবাইকে বিশ্ব সাহিত্যের বই পড়তে দিতো এবং তা নিয়ে পরে আলোচনা করতে বাধ্যকরতেন। রফিক ভাইয়ের আড্ডা থেকে তখনকার উঠতি কবিরা এভাবে উপকৃত হয়েছিল।

তারপর এলো ব্যাংকার, লেখক ফারুক মঈনুদ্দীন। ফারুক তখন এবি ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তা। খুলনায় পোস্টিং। বয়স ওঅববায়িকক উদভাসের অধিক ছিল তার পদমর্যাদার উচ্চতা।

ফারুক মঈনুদ্দীন তার গল্পের চরিত্রের মুখে খুলনার ডায়ালেক্ট বসানোর জন্য খুইলনের কথা রপ্ত করছিল। সাহিত্যে কলোকয়্যালও ডায়ালেক্ট ব্যবহারের প্রধান কাজ হচ্ছে তার অথেন্টিক বোল। ফারুক খুলনার ডায়ালেক্ট এমন ভাবে রপ্ত করেছিল যে হাসানআজিজুল হকের বড়বোন মনে করতেন ফারুকের বাড়ি খুলনায়।

কলোকুয়্যাল ঢুকিয়ে চলমান কবিতার ভাষাকে পাল্টে দেয়ার জন্য হাল সময়ে আঙুলের করে গোণা ঢাকাইয়া যে ক’জন কবিরকোশেশ, তা আমাদের কাছে নতুন কিছু বলে মনে হলেও দুনিয়ার কাব্য রীতিতে তা পুরনো। ধরুন না জাপানী কবি সাকুতারোহাজিওয়ারা Sakutaro Hagiwara এর কথা। সাকুতারো কলোকুয়্যাল দিয়ে প্রচলিত জাপানী কবিতার ল্যন্ডস্কেপ পাল্টেদিয়েছিলেন। যাকে বলে খোলনলচে পাল্টে দেয়া। তিনি কমপ্লেক্স আইডিয়াকে কলোকুয়্যালে ঢেলে দিয়ে নতুন ফর্ম দেয়ার কাজটিকরেছিলেন। তিনি যে কাজটা করেছিলেন তা আমরা শাখামৃগস্বভাব-কবিগণ করতে পারি না; বুঝিও না কীভাবে কাজটি করতেহয়, বা সেই মুরোদ আমাদের নেই।

সাকুতারোর প্রথম কিতাব, Howling at the Moon বা তার ‘প্রোজ-পোয়েম-নভেলা’ Cat Town কিম্বা Blue Cat (নীলবেড়াল, Aoneko) কিতাবে জানা যায় মনোজগতের জটিল কারবার হাট-বাজারের আটপৌরে শব্দে শব্দে কি ভাবে চারিয়ে দিতেহয়।

খালি ‘বুঝলা নি মিয়া’, ‘ক্যাম্নে কি’, ‘আবার জিগায়’, ‘আজিজে যামু’ ইত্যকার আওয়াজ দিয়া কবিতার শীলিত শব্দ পাল্টে দিতেচাইলে কবিতার ল্যান্ডস্কেপ পাল্টাবে না।

মিয়া ভাই, আজিজে আড্ডা দিয়ে সবাই কি আর শর্টকাটে সাকুতারো হাজিওয়ারা হৈতো ফারে নি?

মেধা দরকার, সৃষ্টিশীল ধীদীপ্তি চাই। সবাই কি আর মাইকেল মধূসুদন দত্ত …’আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে’…বলেকবিতার ব্রাহ্মণ্যবাদের ছুৎমার্গ ছিঁড়তে পারে?

ভণ্ডামি করে আর যাই হোক কবিতার খোলনলচে পাল্টানো যায় না। আড্ডায় মেধাবী কবি ও লেখকের সন্নিধান দরকার।
কে আসেনি কবি কর্নারে। শহীদ কাদরী, রফিক আজেদ থেকে শুরু করে কতো রথী-অতিরথী-মহারথী এসেছিলেন। তাদের সঙ্গেযে আড্ডা হয়েছিল তার অভিঘাত তরঙ্গে আজও বাজে।

আড্ডা শব্দটি বাঙালির নিজস্ব একটা শব্দ যার প্রতিশব্দ পৃথিবীর কোন ভাষায় নেই। আড্ডা ছাড়া আমরা বাঙালিরা দিনগুজরান করতে পারি না। আড্ডায় আড্ডায় বেড়ে উঠি আমরা আড্ডাপ্রিয় মানুষেরা। সে ক্ষেত্রে হোমল্যান্ড কি হোস্টল্যান্ড — সবখানে সময়ভূক আড্ডায় কাটে আমাদের দিনরাত্রির কড়চা।

নিউ ইয়র্কের কুইন্স ও ব্রুকলিনে এন্তার দেশি আড্ডা চোখে পড়ে। জ্যাক্সন হাইটসে রাস্তার পাশে মুড়ি চানাচুরঅলার খোলা চৌকিঘিরে কিছু তরুণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে মুড়ি চিবানোর মতো। সেই আড্ডা চলে ঘন্টার পর ঘন্টা।প্রিমিয়ারের দুপাশে চিকনগলিতে দেখা মেলে ওপেন-এয়ার আড্ডায় একদল তরুণের, যারা দাড়িকমাযতিচিহ্নহীন কথায় বকবক করছে তো করছেই।হিলসাইড এভেন্যুর ১৬৭ স্ট্রীট থেকে ১৭০ স্ট্রীট পর্যন্ত সাইডওয়াকে হকার আর টকার গিজগিজ করে সেখানে হাঁটা যায় না।

ব্রুকলিনের চার্চ-ম্যাগডোনাল্ড বা ইস্ট নিউ ইয়র্কের ফুলটনেও দেখা যায় একই দৃশ্য। দলে দলে দেশি লোকজন গলগল করেবাৎচিৎ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশি রেস্তরাঁর টেবিলে টেবিলে উচ্চকন্ঠ আড্ডাতো রোজকার রুটিনওয়ার্ক।

মূলধারায় ঢুকতে না পেরে আমরা নিজেদের ভিতরে ঢুকে যাই। মূলধারার বাইরে আমাদের আড্ডা মাল্টাই-কালচারাল এরিনায়দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্নতা যাপন।

ইটিং হ্যাবিট যেমন বদলানো যায় না, মাদার-টাঙ ছাড়া তেমন আড্ডা হয় না। আমরা সবাই এই দূরবাসে, পরবাসের আড্ডায়ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি ও দেশি রাজনীতির অসার কথার সংঘাতে মেতে থাকি। টেবিলে টেবিলে, সাইডওয়াকে, কারো বাসারবেজমেন্টে আড্ডার বন্ধ্যা সময় পার করি। তাইতো হোস্টল্যান্ডে বাঙ্গাল আড্ডা ইন্টেলেকচুয়াল, সৃজনমুখর, আড্ডার চাইতে বেশিগ্যান্জাম ও গীবৎ আয়াতের আড্ডা।

নিউ ইয়র্কে কবি শহীদ কাদরীকে কেন্দ্র করে একটা আধা ফর্মাল, আধা ইনফর্মাল মাসিক আড্ডা প্রযোজনা করেছিল। সেইআড্ডাটা ঘটেছিল একটা দালান বাড়ির বেজমেন্টে। সেই আড্ডাটা ছিল অনিতা দেশাই এর ‘ইন কাস্টডি’ উপন্যাসের কবি নূরেরদ্বিতীয় স্ত্রীর আড্ডার মতো। সেই আড্ডাটা নিয়ন্ত্রন করতো উপন্যাসের অ্যান্টাগনিস্ট সরলা, কবি নূরের নয়া বিবি। যেখানেসরলার কৌশলের বেড়িতে ট্র্যাপড হয়ে বসে থাকতো কতিপয় মুরিদপ্রতিম লোক। কবিতার নতুন মাত্রা নির্মাণ ও বিস্তারের আড্ডাছিল না সেটা। অথচ সেই আড্ডাটা হতো ক্লাসিক উর্দু কবিতার মশহুর কবি নূরের নামে।

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের যাতনা থেকে মুক্তি পেতে কাদরীকে দিয়ে অমোন একটা অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। যতোটা কবিতার কদরহতো তারচে অধিক ছিল সেটা নিয়ে কাগজে পাতা বোঝাই সচিত্র সংবাদ ছাপবার খায়েশ। আশা করা গিয়েছিল কাদরী প্রবাসীকবি ও তাদের কাব্য সম্ভাবনা নিয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু না, কাদরী লিখতে পারেননি রিলকের ‘লেটারস টু এ ইয়ং পোয়েট’ এরমতো কোন কিতাব।কাদরীকে তার স্তাবকেরা চিরকাল যতোটা কবি তারচে বেশি বলেছে আড্ডাবাজ কাদরী। দু:খজনক!

কাদরী-কেন্দ্রিক আড্ডা ছাড়াও নিউ ইয়র্কে সাহিত্যর আরো কয়েকটি স্বল্পদিনস্থায়ী আড্ডা চলেছিল। সেগুলো ছিল জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সলীমুল্লাহ খাঁন, হাসান ফেরদৌসদের আড্ডা ক্লান। সে সব আড্ডা ছিল ক্ল্যানের চীফটেন হওয়ার অসুস্থ অভীপ্সারআড্ডা। একে অপরকে গুতো মেরে হটিয়ে দেয়ার অশুভ গোত্তাগুত্তির মিন-মাইন্ডসেট আড্ডা। সাহিত্যকেন্দ্রিক সেই আড্ডাগুলোটেকেনি। দোলনায় মরে যাওয়া শিশুর মতো অপসৃয়মান হয়ে গিয়েছিল। তারা কেউ কবিতা ও সাহিত্যের জন্য কোন সুখবর এনেদিতে পারেনি।

পশ্চিমের আড্ডার টেবিল কখনো ছিল না আড্ডার বন্ধ্যা টেবিল। তারা আড্ডার টেবিলে নতুন নতুন চিন্তা তুলে ধরেছিলেন।নবতর চিন্তা ও প্রয়োগিক চেতনার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। প্যারীর Existentialist Cafe’র টেবিলে শুধু কফি বা ককটেলে বুঁদহওয়ার জন্য যেতো না সেখানকার আড্ডাবাজেরা। সেখানে যারা আড্ডার ককটেল টেবিলে মশগুল থাকতো তাদের মধ্যেঅন্যতম ছিলেন সীমন ডি ব্যুভোয়া, জাঁ পল সার্ত্রে এবং রেমন্ড অ্যারন। সার্ত্রে সেই টেবিলে রেমন্ড অ্যারনের কথা থেকে পেয়েযান ফেনোমেনলজির জীবন সম্পৃক্ত ধারনা।এডমন্ড হাসার্ল এর ফেনোমেনোলজির দার্শনিক ব্যাখ্যার চাইতে স্পস্টতর ব্যাখ্যাসার্ত্রে পেয়ে যান অ্যারনের কথায়। ফেনোমেনোলজির ইতিহাসে এক্সিটেনসালিস্ট ক্যাফের টেবিল এভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

রোমান্টিক ও ভিক্টোরিয়ান যুগ (era) ক্ষয়ে যাওয়ার পর মর্ডানিস্ট কবিদের উত্থানপর্ব ঘটতে থাকে।লন্ডনে তখন কবিদেরঅনেকগুলো আড্ডা মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সেই সব আড্ডার সেন্টার-অব-গ্রাভিটি ছিল এলিয়ট, এজরা পাউন্ডদের আড্ডা।তারা কবিতায় আধুনিকতার মননভূমি নির্মান করেছিলেন। বিন্যাস করে চলেছিলেন আধুনিক কবিতার যৌক্তিক দিক, বিজ্ঞানমনস্কতা ও মানবিকতার মনোভূমি। কবিতার আঙ্গিক বিন্যাসকে ভেঙেছিলেন। ছন্দকে ভেঙেছিলেন। কবিতায় অনবদ্যরূপকল্প নির্মাণ করেছিলেন। সন্দিগ্ধমন কবিতার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। রোমান্টিক কবিতার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন।লিরিকের ললিত কথার গায়ে কঠোর কথার গাইতি চালিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন নিরঙ্কুশ লিরিক্যাল উচ্চারণ।

এলিয়ট তাঁর আড্ডায় রবীন্দ্রনাথকে যেমন সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওয়েলস এর ডোয়ার্ফ মানচিত্রের টিনএজ জায়ান্টকবি ডিলান টমাসকে তেমন ডেকেছিলেন। ধীদীপ্ত ডিলানের তীব্র কাব্য প্রতিভার সংগে মুখোমুখি বসেছিলেন এলিয়ট।

এলিয়টের আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ পৌঁছুতে না পারলে তিনি কি অতো সহজে নোবেল প্রাইজ লাভ করতে পারতেন?

মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন বৈকি!
উইলিয়াম রদানস্টাইন ইয়েটসের কাছে রবীন্দ্রনাথের পান্ডুলিপি সম্পর্কে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিলেন। ইয়েটস লন্ডনে এলিয়টেরআড্ডায় এসেছিলেন। পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের পান্ডুলিপি। রবীন্দ্রনাথের পান্ডুলিপিতে ইয়েটস দেখতে পেয়েছিলেন অনুবাদেরকিছু অসঙ্গতি। ইয়েটস সময় নিয়ে নিবিড় ও সন্তর্পণ অভিনিবেশে সেগুলো শুধরে দিয়েছিলেন। যদি শুধরে না দিয়ে সেইপান্ডুলিপি নোবেল কমিটিতে জমা দিতেন, তবে, নোবেল পেতেন কিনা সন্দেহ। একেকটা শব্দের জাত্যার্থ বা কনোটেশান স্থানভেদে একেকরকম। বাংলাদেশে ‘কোলাবরেটর’ বলতে আমরা বুঝি রাজাকার, আলবদর, আল শামস। কিন্তু পশ্চিমেকোলাবরেটর শব্দের অর্থ অ্যাবসল্যিউটলি পজিটিভ।

পশ্চিমের আড্ডা নানা রকম উদ্ভাবনার আড্ডা। পশ্চিমে কবিদের আড্ডা চিরকাল জমজমাট ছিল। ইংলিশ সাহেব কবিদেরআড্ডা, বাঙালি বাবু কবিদের আড্ডা আর বাংলাদেশের বাঙাল কবিদের আড্ডা আলাদা আলাদা অবয়বে বেড়ে ওঠে। তবেপশ্চিমের আড্ডায় বাঙালি আড্ডার যে অবারিতপ্রাণ জোয়ার, তা পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর আড্ডা বিষয়ে লেখাপ্রবন্ধ ‘আড্ডা’ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দিলে সেটা বোঝা যাবে! বুব কহেন, “অত্যন্ত হাসি পায় যখন শুভানুধ্যায়ী ইংরেজআমাদের করুণা করে বলে—আহা বেচারা, ক্লাব কাকে বলে ওরা জানে না। আড্ডা যাদের আছে, ক্লাব দিয়ে তারা করবে কী? আমাদের ক্লাবের প্রচেষ্টা কলের পুতুলের হাত-পা নাড়ার মতো, ওতে আবয়বিক সম্পূর্ণতা আছে, প্ৰাণের স্পন্দন নেই — আমাদের ঋতুগুলি যেমন কবিতা জাগায়, তেমিন আড্ডাও জমায়। আমাদের চৈত্রসন্ধ্যা, বর্ষার সন্ধ্যা, শরতের জ্যোৎস্না-ঢালারাত্রি, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল—সবই আডডার নীরব ঘণ্টা বাজিয়ে যায়।”

আড্ডার বড় দিক হলো আড্ডার মেন্টর। আড্ডা যদি ভুল মেন্টর, মিথ্যাকথনপ্রিয় আড্ডাবাজের খপ্পরে পড়ে তখন সেইআড্ডার সর্ববিদ্যাকল্পদ্রুম বিপজ্জনক মুর্খতায় পল্লবগ্রাহী হয়ে পড়ে। সেখানে বহে জ্ঞান-দূষণের বাতাস। আড্ডা গিয়ে পড়েগাড্ডায়। সব আড্ডারই মেন্টর দরকার তা সে কবি হন বা রাষ্ট্রনায়ক হন, শিল্পী হন বা দার্শনিক হন। সলিল চৌধুরী বলতেন, যদি আইপিটিএ তে যাওয়া না হতো, আমি এই সলিল চৌধুরী হতে পারতাম না।

পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাঁর পলিটিক্যাল মেন্টর পন্ডিত মৌলানা আযাদ এর সংগে কাটাতেন। বিষ্যুদ্বারকাটাতেন আপ্পুঘরে শিশুদের সংগে। আহরণ করতেন শিশুর সারল্য ও তারুণ্য।

লিটারেরি থিওরিস্ট বিশেষ করে পোস্ট: কলোনিয়াল লিটারেরি থিওরিস্ট এবং দুনিয়া স্পন্দিত করার প্রজ্ঞাবান, ধীদীপ্তপ্রথাবিরোধী লেখক, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল এডওয়ার্ড সাইদ ওর ওরিয়েন্টালিজম বইয়ের পঁচিশতম সংস্করনের ভূমিকায়বলেছেন, তাঁরও ছিল ইন্টেলেকচুয়াল মেন্টর। তাদের মধ্যে ইব্রাহিম আবু-লুঘাদ এবং ইকবাল আহমেদ ছিলেন অন্যতম।

কি বলে! সাঈদের আবার ইন্টেলেকচুয়াল মেন্টর?

সবারই প্রয়োজন মেন্টরের।

কিছুদিন একটা সান্ধ্য আড্ডা জমাতে চেয়েছিলাম জ্যাক্সন হাইটসের প্রিমিয়াম রেঁস্তরায়। জমেনি শেষতক। আড্ডার কেন্দ্রে ছিলযে আড্ডা-উবাচ, সে হরহামেশা কবিতা-কথার বদলে বয়ান করতো জিন্নাহ, জিয়াকে নিয়ে স্তুতিকথা। চারিয়ে দিতে চাইতোদক্ষিণপন্থী রাজনীতিপ্রীতি অধিক মাত্রায়। মুসলিম লীগ, বিএনপি রাজনীতি ও পাকিস্তান-প্রীতি ছিল তার কাছে মূখ্য। সেইআড্ডাটা টিকতে পারেনি। অনিবার্য ভাবে সেটা ভেঙেছিল। আদর্শিক সম্পর্ক ব্যক্তিগত সম্পর্কের উর্ধে। আদর্শের সংঘাততীব্রতর হয়ে ওঠে তা যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে রাজাকারইজম সমর্থনের সংঘাত।

এখন আমার আড্ডা ছোট হয়ে এসেছে, যাকে বলা যায়, অবক্ষীণ। একজন কবিকে নিয়ে যাই বাউরী পোয়েট্রি ক্লাবে। মন বসে না সেখানে। সবকিছুই কেমন অচেনা লাগে। ঘন্টা দুয়েক পরে ক্যান্ডেল-লাইট টেবিল ছেড়ে উঠে যাই।বেরিয়ে পড়ি ডাউনটাউন ম্যানহাটনে। ওয়েস্ট ভিলেজ ধরে হাঁটতে থাকি। কবিবন্ধু গায়িকাও বটে। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বাংলা গান ধরেন উঁচু স্কেলে।ডাউনটাউন ম্যানহাটানের পথচারীরা অবাক হয়ে শোনে ভিনদেশি বাণী ও সুর। এখানে একদা আড্ডায় মুখর ছিলেন অ্যালেনগীন্সবার্গ, জ্যাক কেরুয়াক, ওয়েলসীয় কবি ডিলান টমাস। এখানে ওদের ঘ্রাণ ম ম করে।

তবু এসব আমাদের নয়। চিরপৃথকতা আমাদের করে রাখে ভীড়ের ভিতর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। অচিনপুরে চিরচেনা একটা আড্ডা চাই।সেটা কি হতে পারে?

বসে থাকি স্টারবাকস ক্যাফের টেবিলে একা। চুমুকে চুমুকে পান করি একেলা বেলা। হাডসন নদীর কাছে জলজ বিলে দেখিএকঝাঁক ধূসর কাশফুল শীষের দোলা। আমার যাবার জায়গাগুলো দেখি রুদ্ধ। কে দিয়েছে সব দরোজায় তালা! হয়তো নিজেই।হিপোক্রেসির যাতায় মানুষেরা নিঃসঙ্গ হতে ভালোবাসে। যাওয়ার জায়গাগুলো দ্রুত হয়ে যায় উপদ্রুত।
নিউ ইয়র্ক জুলাই ২০২৩

শেয়ার করুন