নিউইয়র্ক     শনিবার, ১২ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৭শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আটলান্টিক পার হলেই কি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলে যায় ? -সংসদে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
আটলান্টিক পার হলেই কি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলে যায় ? -সংসদে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

আমেরিকা চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদ নেতা বলেন, তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তা ওকালতি করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে এখানে এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে- যার গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অগণতান্ত্রিক ধারা। সেই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবী, সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের তাবেদারি করে, পদলেহন করে। আমেরিকা তাদের গণতন্ত্র আটলান্টিক পাড় পর্যন্ত চর্চা করে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী বলেন, আটলান্টিক পার হলেই কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলে যায়। গত ১০ এপ্রিল সোমবার জাতীয় সংসদে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আনা ১৪৭ বিধির সাধারণ প্রস্তাব ও অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে এসব কথা বলেন।

সংসদ নেতা তার বক্তব্যের বড় অংশ নিয়ে বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত না দেয়াসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। কথা বলেন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনী প্রস্তাবের দাবি, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোকে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবর নিয়েও।  একই সঙ্গে ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’ প্রসঙ্গ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই বিচিত্র। আমরা আইয়ুব আমল দেখেছি। ইয়াহিয়া আমল দেখেছি। জিয়ার আমল দেখেছি। জেনারেল এরশাদের আমল দেখেছি। খালেদা জিয়ার আমলও দেখেছি।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্র সফরে একটি বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে সরকার প্রধান বলেন, আমেরিকায় যখন প্রথমবার যাই সেখানকার আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে আমার মিটিং হয়েছিল। বলেছিলাম আমি একটি মন্যুমেন্ট দেখে এসেছি। সেখানে লেখা আছে গভর্নমেন্ট অব দ্যা পিপল, ফর দ্য পিপল বাই দ্য পিপল। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি সেদেশটি হচ্ছে গভর্নমেন্ট অব দ্যা আর্মি, বাই দ্যা আর্মি, ফর দ্যা জেনারেল। বলেছিলাম- আমেরিকা গণতন্ত্র চর্চা করে তাদের আটলান্টিকের পাড় পর্যন্ত। এটা যখন পার হয়ে যায় তখন কী আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা বদলে যায়? কেন আপনারা একটা মিলিটারি ডিক্টেটরকে সমর্থন দিচ্ছেন? আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম।

বিভিন্ন দেশের বিষয়ে বর্তমানে মার্কিন অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আজকেও আমি বলি- যে দেশটা আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের ছবক দেয়। আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কোদন করছেন, উঠবস করছেন। উৎফুল্ল হচ্ছেন। হ্যাঁ তারা যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পারেন। পাল্টাতে পারেন। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলি তো আরো বেশি কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আরব স্প্রিং (আরব বসন্ত) ডেমোক্রেসি সব বলে বলে, যেসব ঘটনা ঘটাতে ঘটাতে এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে একটা প্যাঁচে পড়ে গেছেন। যতদিন ইসলামিক দেশগুলোর ওপর চলছিল, ততদিন কিছু হয়নি। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পরে এখন সারা বিশ্বই অর্থনীতিক মন্দার কবলে পড়ে গেছে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, তারা আমাদের গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী? কয়েকদিন আগের কথা, আমেরিকার টেনেসিস রাজ্যে তিনজন কংগ্রেস- এই তিনজনের অপরাধ হচ্ছে তারা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন করেছিল। তারা ডেমোনেস্ট্রেশন দিয়েছিল যে, এই ভাবে যার তার হাতে অস্ত্র থাকা আর এইভাবে গুলি করে শিশু হত্যা বন্ধ করতে হবে। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। আর এই অপরাধে এই দুজনকে কংগ্রেস থেকে এক্সপেল করা হয়। জাস্টিস জন ও জাস্টিস পিয়ারসন। একজন সাদা চামড়া ছিল বলে বেঁচে যায়। বাকি দুজনের  অপরাধ হলো তারা কালো চামড়া। সেই কারণে তাদের সিট আনসিট হয়ে যায়। তো এখানে মানবাধিকার কোথায়! এখানে গণতন্ত্র কোথায়? এটা আমার প্রশ্ন।

তিনি বলেন, ১৫ আগস্টে যারা হত্যা করেছে সেই খুনি রাশেদ (রাশেদ চৌধুরী) আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে আছে। সেখানে যত প্রেসিডেন্ট এসেছে সকলের কাছে আমি আবেদন করেছি। আইনগতভাবে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়েছি। আমরা ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়েছি। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি যে এই খুনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি তাকে আপনারা আশ্রয় দেবেন না। শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারী, রাষ্ট্রপতির হত্যাকারী, মন্ত্রীর হত্যাকারী। এটা মানবতা লঙ্ঘনকারী। এদের আশ্রয় দিয়েন না। ফেরত দেন। কই তারা তো তাকে ফেরত দিচ্ছে না। খুনিদেরকে লালন পালন করেই রেখে দিচ্ছে।

স্বাধীনতা দিবসের দিন দৈনিক প্রথম আলোকে প্রকাশিত একটি খবরের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র একটা ছোট্ট শিশুর হাতে ১০ টাকা দিয়ে তাকে দিয়ে একটা মিথ্যা বলানো। শিশুর মুখ থেকে কিছু কথা বলানো। কী কথা! ভাত-মাছ-মাংসের স্বাধীনতা চাই। একটা সাত বছরের শিশু। তার হাতে ১০টা টাকা তুলে দেয়া এবং তার কথা রেকর্ড করে সেটা প্রচার করা— স্বনামধন্য এক পত্রিকা। খুবই পপুলার। নাম তার প্রথম আলো। কিন্তু বাস করে অন্ধকারে। প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু। প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু। প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু। এ সময়ে সংসদ সদস্যরা ‘শেম’, ‘শেম’ বলে তিরস্কার করেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলি- যে এরা এই দেশে কখনোই স্থিতিশীলতা থাকতে দিতে চায় না।

ওয়ান ইলেভেনের সময় দুটি পত্রিকার ভূমিকার সমালোচনার করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৭ সালে যখন ইমার্জেন্সি হয়, তখন তারা উৎফুল্ল। দুটি পত্রিকা। আদাজল খেয়ে নেমে গেল। বাহবা কুড়ালো। আর তার সঙ্গে আছে- একজন সুদখোর। বড়ই প্রিয় আমেরিকার। আমেরিকা একবারও জিজ্ঞাস করে না— যে একটা ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক। এটা তো একটা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সরকারের বেতন তুলতো যে এমডি, সে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কোথা থেকে পেল যে, আমেরিকার মত জায়গায় সামাজিক ব্যবসা করে, বিনিয়োগ করে দেশে-বিদেশে। এই অর্থ কোথা থেকে আসে? এটা কী জিজ্ঞাসা করেছে কখনো তারা? জিজ্ঞেস করেনি। এদের কাছ থেকে দুর্নীতির কথা শুনতে হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ। এদের কাছ থেকে মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়। যারা গরীবের রক্ত চোষা টাকা পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগ করে নিজেরা শতকোটি টাকা মালিক হয়ে আবার আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও পেয়ে যায়। এই সব লোক এদেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। আওয়ামী লীগ সরকার এসে কিছুই নাকি দেয়নি। দেশ নাকি ধ্বংস হয়ে গেছে।

৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেকেরেই আপত্তি। যারা এই আপত্তির কথা তুলছেন তাদের বোধহয় অভিজ্ঞতার অভাব আছে। এই ৭০ অনুচ্ছেদটাই কিন্তু আমাদের দেশে সরকারের একটা স্থায়িত্বের সুযোগ এনে দিয়েছে। যার ফলে দেশটা উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ফ্লোর ক্রস করার কারণে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকতে পারেনি। এর আগে ১৯৪৬ সালেও একই খেলা হয়েছিল। যার কারণে আমাদের পূর্ব বাংলাটা যেভাবে গঠন হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি। এটা ১৯৫৬ সালের নির্বাচনেও হয়েছিল। পরে মার্শাল ল এসে ক্ষমতা দখল করে। কাজেই এই ৭০ অনুচ্ছেদটাই একটি সুরক্ষা দেয় গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে। আর এর সুফল জনগণ পেতে পারে। জানিনা কেন কিছু কিছু সদস্য এর ওপর এত রাগ। কারণ হচ্ছে সরকার ভাঙতে গড়তে বা খেলাটা খেলতে তারা সক্ষম হচ্ছে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

আওয়ামী লীগ কী করেছে তার আর আগে কী ছিল- তার কয়েকটি হিসাব তুলে ধরতে চাই, আমি বিশ্বাস করি দেশের মানুষও বিশ্বাস করে ১৪ বছর একটানা ক্ষমতায় আছি বলেই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছি। হ্যাঁ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তারপরও আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের মানুষের জন্য অতিরিক্ত দামে জিনিস কিনে এনেও আমরা খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি। নিম্ন আয় মধ্যম আয় সকলের দিকে আমাদের দৃষ্টি আছে। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষের ভাগ্য গড়তে। এখন গ্রাম আর শহরের পার্থক্য কমে গেছে। শহরের মাঝখানে আরেকটা শহর গড়ে উঠছে। প্রত্যেকটি গ্রামে আমরা নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দিচ্ছি।

বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তো কোনো  প্রশ্ন উঠেনি। যে বিরোধী দলকে বড় বিরোধী দল বলা হয় তারা ২০০৮ সালে ২৯টি সিট পেয়েছিল। তারা যদি এত বড়ই বিরোধী দল হয়ে থাকে তাহলে ২৯টি সিট পেল কেন?  আর সাজাপ্রাপ্ত আসামি হচ্ছে সেই দলের চেয়ারপার্সন। হত্যা-গুম-খুন-দুর্নীতি-জঙ্গিবাদ-সবকিছুতেই যারা পারদর্শী ছিল। তাদের জন্য দেশের মানুষ আতঙ্কে থাকতো। এখন তাদেরকে নিয়ে এত উৎফুল্লতা শুরু করছে। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য। তিনি বলেন, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমান পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এটাই আমাদের কথা। যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছিলাম, অনেকই নাক সিঁটকেছিল। বলেছিল এটা আবার কী। এখন সে ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে নানা রকম কুৎসাও রটায়। সুফল-কুফল দুইটোই আছে। মানুষ সুবিধা পাচ্ছে।

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন