নিউইয়র্ক     বুধবার, ১৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ  | ৫ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভারতীয় হিন্দুরা বাংলাদেশের হিন্দুদের সম্পর্কে যা বোঝে না

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০২:২৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০২:২৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ভারতীয় হিন্দুরা বাংলাদেশের হিন্দুদের সম্পর্কে যা বোঝে না

৫ আগস্ট যখন আমি শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করার খবরটি দেখছিলাম, তখন একজন বাঙালি হিন্দু হিসাবে আমি দ্রুত নিজের মধ্যে দুটি আবেগ অনুভব করেছি: ছাত্র বিক্ষোভকারীরা যা অর্জন করেছে তাতে আনন্দ এবং বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে হিন্দুদের সাথে কী ঘটতে পারে তার জন্য ভয়। এই ভয় অমূলক ছিল না। ভারত ও বাংলাদেশের বাঙালি হিন্দুরা জানে, কয়েক দশক আগে পূর্ব বাংলায় যখন বিশৃঙ্খলা নেমে এসেছিল, তখন হিন্দুরা ছিল হামলার লক্ষ্যবস্তু। সেই রাতে (৫ আগস্ট) পূর্বাভাস অনুযায়ী খবর আসতে শুরু করে যে, চরমপন্থিরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করার জন্য হাসিনার রেখে যাওয়া ক্ষমতার শূন্যতার সুযোগ নিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যেমনটা উল্লেখ করেছে, রাজনৈতিক কুশীলবরা তাদের বিরোধীদের আক্রমণ করার জন্য ক্ষমতার শূন্যতার সুযোগ নিয়েছিল এবং চরমপন্থিরা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের আক্রমণ করার সুযোগটি নিয়েছিল।

এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশিরা সাংগঠনিকভাবে হিন্দুদের মন্দির, খ্রিস্টানদের গির্জা এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের মতো ছাত্র আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে সব সম্প্রদায় বাংলাদেশের ধারণাকে রক্ষা করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এবং তাদের নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মোহাম্মদ ইউনুস জোর দিয়ে বলেছেন, পরবর্তী সরকার অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ হবে যা সংখ্যালঘুসহ সবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে সম্মান করবে। পূর্ব বাংলার ইতিহাসে বাঙালি হিন্দু ছাত্ররা সবসময়ই ছাত্রদের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

বাংলাদেশিরা যখন আরেকটি স্বাধীনতা উদযাপন করছে, তখন সংখ্যালঘুরা দাবি করছে তাদের মুক্তির এই নতুন যুগে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। তারা বাংলাদেশ সরকারের মৌলিক সংস্কার চায়, যার মধ্যে একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সংসদে সংখ্যালঘুদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ।

যাইহোক, ভারতীয় ও প্রবাসী হিন্দুরা গণহত্যা থেকে অসহায় বাংলাদেশি হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য আবেদনের বোমাবর্ষণ করেছে। অতি-ডানপন্থিরা মৃত বাংলাদেশি হিন্দুদের বিপুল পরিমাণ ছবি এআই (আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স) ব্যবহার করে বিশ্ব হিন্দু সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের দিকে নজর রাখতে বলেছে। অতি-ডানপন্থি হিন্দু প্রবাসী সংগঠন, যাদের বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো উপস্থিতিই নেই, তারা আমাদের বাংলাদেশি ভাই-বোনদের ভয়কে ব্যবহার করে পরামর্শ দিচ্ছে যে শেখ হাসিনাই একমাত্র বাংলাদেশি হিন্দুদের গণহত্যা থেকে রক্ষা করেছেন। একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট মুহাম্মদ ইউনূসকে অং সান সুচির সাথে তুলনা করেছে। সুচি বহু বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যায় সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিলেন। অথচ ড. ইউনূস তার বিপরীতে সংখ্যালঘু বিরোধী সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, ইউনূস তার ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে সংখ্যালঘু বিরোধী সহিংসতা বন্ধ করার আবেদন করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় হিন্দু মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে, ইউনূস সবার অধিকার রক্ষায় তার আত্মা উৎসর্গের করার কথা বলেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি অংশে প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে নেতারা যেমনটা স্রেফ মতবিনিময় করেন, তার বিপরীতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব অসাধারণ সহানুভূতি ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন।

সংখ্যালঘুদের সমর্থনের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের নেতাদের প্রতিক্রিয়া থেকে ভারতীয় হিন্দুদের শিখতে হবে। বাংলাদেশে আমাদের ভাইদের সাথে যা ঘটছে তা মোকাবেলায় অ-বাংলাদেশি হিন্দুদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। বাংলাদেশি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উগ্র ডানপন্থিদের ভুল তথ্য তাদের প্রকৃত উদ্বেগকে চাপা দিয়ে রাখছে। ভারতীয় ভুল তথ্য প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি হিন্দুদের আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে, কারণ তাদের এই ভয় বিদেশি প্রোপাগান্ডা বলে খারিজ হয়ে যায়।

ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উস্কে দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা ভারতীয় হিস্টিরিয়ায় আক্রান্তের পরিবর্তে, ভারতীয় হিন্দুদের উচিত হাজার হাজার বাংলাদেশি হিন্দুর কথা শোনা, যারা বাংলাদেশি সরকারের কাছে কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসছে। প্রতিবাদী নেতা বিপ্র প্রসূন দাস যেমনটা উল্লেখ করেছেন, প্রকৃত সহানুভূতির সাথে বাংলাদেশি হিন্দুদের উদ্বেগ অন্যান্য হিন্দুদের শোনা প্রয়োজন। ভারতীয়দেরকে সাম্প্রদায়িক লাইনে বিভক্ত করার যে রাজনৈতিক কৌশল তা বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর ব্যবহার করা উচিত নয়। নিজেদের স্বার্থপর প্রয়োজনে একে অপরের গল্প ব্যবহার না করে হিন্দুদের বরং একে অপরের কথা শোনা উচিত।

বাংলাদেশের হিন্দুরা অসহায় নয়। তারা বাইরের শক্তির কাছে নিজেদের বাঁচানোর জন্য আবেদন করছে না। তারা স্বৈরাচারের প্রত্যাবর্তন চায় না এবং তারা অবশ্যই তাদের দেশ ছেড়ে যেতে চায় না। তাদের যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, তাদের দৃঢ় দাবিগুলোকে প্রসারিত করার জন্য সহকর্মী হিন্দুদের সমর্থন, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে, বাংলাদেশ সত্যিই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাষ্ট্র, যা বর্ণ বা জাতি নির্বিশেষে প্রত্যেক বাংলাদেশিকে সমান অধিকার দেয়।

শেয়ার করুন