বাংলাদেশের দেশের অর্থনীতি প্রায় ভঙ্গুর। গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠদের লুটপাটে তছনছ পুরো ব্যাংক খাত। ডলার সংকটে রিজার্ভ নেমে তলানিতে। পাহাড়সম বিদেশি ঋণ।রপ্তানিতে ভাটার টান। আস্থার সংকটে থাকা ব্যবসা-বিনিয়োগে মন্দার প্রভাবে গতিহীন রাজস্ব আয়। ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামল শেষে রীতিমতো ফোকলা অর্থনীতি সামলানোর ভার পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। এর মধ্যে সুযোগ বুঝে দাবি আদায়ের মিছিলে শামিল বিভিন্ন স্তরের স্টেকহোল্ডার।
আছে সংস্কার কর্মকাণ্ডের হাজারো চাহিদাও। এতসব চাপ নিয়েও নতুন সরকার যখন স্বাভাবিক কাজে ফেরা নিয়ে ব্যস্ত, তখনই দেশের একটি অংশের মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। ফলে অভ্যন্তরীণ আয় কম হলেও বিশাল খরচের ফর্দ সরকারের সামনে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এবং অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে আরো জানা যায়, দায়িত্ব নিয়েই এতসব সংকট ও চাহিদা পূরণের মুখে পড়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।
তাই সব চাহিদা মেটাতে সরকারের সামনে এখন টাকা জোগাড়ের কঠিন চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল—আইএমএফের কাছে আরো তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের কাছে বাড়তি এক বিলিয়িন ডলার চেয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এর বাইরেও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ৬৫ কোটি ডলার নেওয়া হবে। আপাতত এসব উৎস থেকেই সরকার ৪.৬৫ কোটি ডলার নিতে চায়।
টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৫৬ হাজার কোটির মতো। শুধু তা-ই নয়, ব্যাংকের লুটে নেওয়া ও পাচারের টাকা ফিরিয়ে এনেও আরো প্রায় এক লাখ কোটি টাকার সংস্থান করতে চায় ড. ইউনূসের সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির ভিত শক্ত করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে হবে। আয় বাড়ানোর বিপরীতে ব্যয় কমাতে হবে। অবশ্য উদ্যোক্তারা তড়িঘড়ি না করে নতুন সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, ‘সরকারের সামনে এখন অনেক চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ। আসলে আমাদের আয় বাড়ানো ছাড়া পথ নেই। আয়ের প্রধান চারটি পথ রয়েছে। রেমিট্যান্স বাড়ানো, রপ্তানি বাড়ানো, বিদেশি ঋণ ও সহায়তা নেওয়া আর বিদেশি বিনিয়োগ আনা। এসব খাতে যেসব সমস্যা ও সংকট রয়েছে, সেগুলো মেটাতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ড. ইউনূস যদি অন্য চাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন, তাহলে তিনি চেষ্টা করলে বিদেশি উৎসর টাকা পাওয়া সহজ হবে। যেকোনো মূল্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, জাপান, যুক্তরাজ্য ও ইইউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে হবে। এ জন্য বাণিজ্যিক কূটনীতিতে জোর দিয়ে এই কাজে দক্ষ লোক দিতে হবে। আর বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি করতে হবে এবং জ্বালাও-পোড়াও থামাতে হবে। না হলে কেন বিদেশিরা এখানে আসবে?’
সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে আরো জানা যায়, সরকারের তহবিলে এখন জোর কম। ঠিকমতো রাজস্ব আয় হচ্ছে না। কিন্তু খরচ অনেক। বাজেটের বেশির ভাগই যাচ্ছে পরিচালন খাতে। এর মধ্যে কতশত চাহিদা এসে হাজির! একসময় ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে উঠে যাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ এখন কমবেশি ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। আগের সরকারের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সেটা ধরে রাখতে পারেনি।
এখন উৎপাদন খাত চাঙ্গা করতে হলে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা আমদানি সহজ করতে হবে। এতে সরকারের আরো ডলার খরচ হবে। সরকারের ধারণা, এর ফলে বিনিয়োগ বাড়বে, উৎপাদন খাত চাঙ্গা হবে এবং মানুষের কর্মসংস্থানে গতি আসবে। ডলারের প্রবাহ বাড়াতে এরই মধ্যে রেমিট্যান্স বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। এতে কিছুটা কাজ হচ্ছে। চলতি মাসের ২৪ দিনে রেমিট্যান্স অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে এসেছে ১৩২ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। তবে শুধু রেমিট্যান্সে অর্থনীতিতে ভর করা যাচ্ছে না।
একদিকে রিজার্ভ বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে ঋণ শোধসহ আমদানি ব্যয় মেটাতেও এখন প্রচুর ডলার প্রয়োজন। তাই আগের সরকারের সময় আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার পর আরো ৩০০ কোটি ডলার বাড়তি ঋণ চায় অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক এ নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সামনের অক্টোবরে ওয়াশিংটনে আইএমএফের বার্ষিক সভায় এ বিষয়ের অগ্রগতি হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজেট সহায়তা হিসেবে বিশ্বব্যাংক থেকে দুটি প্যাকেজে যথাক্রমে ২৫ কোটি ও ৪০ কোটি ডলার পাবে সরকার। এর বাইরে জ্বালানি মন্ত্রণালয় যে এক বিলিয়ন ডলার চেয়েছে, সেটাও বাড়তি যোগ হবে।’
জানা যায়, এগুলোর বাইরেও বিশ্বব্যাংকের আরো বহু প্রকল্পে ডলার আসবে। তবে বাজেটে খরচের জন্য নয়; সেগুলো যাবে প্রকল্প ব্যয়ে।
টাকার অভাবে সরকার জ্বালানি খাতের দায় শোধ করতে পারছে না। বর্তমানে এই খাতে প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলারের দেনা রয়েছে। জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সম্প্রতি এ দায় শোধে বিশ্বব্যাংকের কাছে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা চেয়েছেন।
এদিকে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে পাচার করা এক লাখ কোটি টাকা ফিরিয়ে আনার কথা জানানো হয়েছে। এই লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও বিবৃতিতে বলা হয়।
সরকারের ঘাড়ে আগের সরকারের প্রায় ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা পড়েছে। বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পে চীন, রাশিয়া থেকে উচ্চসুদে বড় বড় ঋণ নিয়েছে আগের সরকার। সামনে এসব ঋণের কিস্তি শোধ করতে হবে। ইআরডির সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরে সরকারকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণের দায় শোধ করতে হবে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৫৩ হাজার কোটি। গত অর্থবছরে এটা ছিল ৩.৩৬ বিলিয়ন ডলার। এই চাপ সামলাতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে।
সাম্প্রতিক সহিংস রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভাবমূর্তি সংকট তৈরি হওয়ার কারণে কয়েক মাস ধরেই পোশাকের ক্রয়াদেশ কমছে বলে উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পোশাক খাতের এক উদ্যোক্তা বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের লেনদেনে ও ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ির কারণে ক্রেতারা আতঙ্কে আছেন। এটি পোশাকের রপ্তানিতে ঝুঁকি তৈরি করছে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে সরকারের কাছে সংকট কাটাতে দুই হাজার কোটি টাকার সহজ ঋণ চেয়েছেন। ফলে এটিও সরকারের জন্য চাপ তৈরি করছে বলে অনেকে মনে করছেন। শুধু পোশাক খাতই নয়, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির। একেক দিন একেক স্টেকহোল্ডার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরসহ সচিবালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। এসব দাবির কিছু কিছু মেটানো হলেও সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। দেশব্যাপী সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুরের ফলে এসব মেরামতেও লাগবে টাকা।
শুধু বিদেশি ঋণই নয়, সরকারের সামনে পাহাড়সম চাহিদা পূরণে চলতি অর্থবছরেও বড় অঙ্কের ঋণ নিতে হতে পারে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। গত অর্থবছরে সরকার ৮৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এবার তা আরো বাড়তে পারে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার টাকা ছাপিয়ে ঋণ নিতে চায় না, তবে রাজস্ব আয়ে কোনো গতি না থাকায় সামনে সরকারের খরচের ফর্দ বাস্তবায়ন করতে হলে অভ্যন্তরীণ ঋণ নিতেই হবে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সুদের হার বাড়িয়ে মানুষের হাতের নগদ টাকা ব্যাংকে ঢোকাতে চাইছে। দুই দিন আগেও নীতি সুদহার ০.৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে। এতে আমানত ও ঋণের সুদ বাড়বে। মানুষ টাকা ব্যাংকে ঢোকাবে, আবার ব্যাংকের টাকা ঋণ হিসেবে মানুষের হাতে কম যাবে। এই টাকা থেকেও সরকারের ধার নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।
অর্থনীতিতে যেভাবে সংকট বাড়ছে, সেই সময়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় না বাড়লে দায়দেনার পরিমাণ আরো বাড়বে। তখন নতুন সরকারকেও দেশ পরিচালনা ও বাজেট বাস্তবায়নের জন্য দেশি-বিদেশি উৎসর কাছে হাত পাততে হবে।
নতুন সরকারের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং—সানেমের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘নতুন সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে সংঘাত ও সহিংসতা বন্ধ করে সবার মধ্যে আস্থা ফেরানো। এর পরই রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা। আমাদের সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে গেছে। ব্যবসায় আক্রমণ ও দখলদারি আছে। নতুনরা সক্রিয় হচ্ছে। এগুলো কত দ্রুত থামানো যাবে সেটাই হবে আসল কাজ।’
নিট পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ও বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন, ‘নতুন সরকারকে সময় দিতে হবে। কারণ অর্থনীতিতে এতগুলো সংকট শিগগিরই তাঁরা সমাধান করতে পারবেন এমন আশা করা ঠিক হবে না। আমার প্রত্যাশা হলো, তাঁরা যেন ধীরেসুস্থে কাজগুলো করেন। এরই মধ্যে আমাদের ইমেজের ক্ষতি হয়েছে। এটা মেরামত করতে হবে।’সুত্র দৈনিক কালের কন্ঠ