ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত মিয়ানমারের প্রাচীন শহর বাগান। মন্দির ও প্যাগোডা শোভিত এ তীর্থ একসময় লাখ লাখ পর্যটকে মুখরিত থাকত। বিদেশীরাও এর আকর্ষণ অগ্রাহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থান সবকিছু বদলে দিয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত অং সান সু চির সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। এরপর বাগানের ঐতিহ্যবাহী সোনালি প্যাগোডা ও উপাসনালয়গুলো কার্যত পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। এ চিত্র শুধু বাগানেরই নয়, মিয়ানমারের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রেরও।
নতুন রাজধানী নেপিদোর উত্তর-পশ্চিমের পবিত্র স্থান বাগানে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কো মিনের। ৫০ বছর বয়সী মিন জানান, স্কুলের গণ্ডি পার করে এখানে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। বন্ধুদের সঙ্গে পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড ও ফুল বিক্রি করতেন। কিন্তু মহামারীর পর অভ্যুত্থানে সবকিছুতে ধস নেমেছে। দর্শনার্থী না আসায় তার জীবনযাত্রায় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, সাধারণত এ ধরনের সাময়িক পরিস্থিতির সঙ্গে আমরা মানিয়ে নিতে পারি। কিন্তু এখন সময়টা অনেক বেশি দীর্ঘ। অনেকেই বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করছে। তরুণরা এখন ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয়ের মতো বড় শহরে গিয়ে কাজ খুঁজছে।
কো মিন এ বিপর্যয়কে শুধু বৈষয়িক অর্থে দেখছেন না। প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপনাগুলো নিয়েও তিনি চিন্তিত। স্থানীয়রা ঐতিহ্যবাহী কাঠামোগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করে এর জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থা টিকিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, প্রবীণরা তাদের শিখিয়েছিলেন কীভাবে স্থাপনাগুলো যত্ন নিতে হয়, যা শুধু বাগানের লোকেরা জানে। কিন্তু এখন অযত্নের কারণে এগুলো ধ্বংসের মুখোমুখি।
ইয়াঙ্গুনের একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করেন কিয়াও কিয়াও। তিনি বাগানেই বড় হয়েছেন। একসময় পর্যটকদের কাছে নানা ধরনের স্মারক বিক্রি করলেও এসব এখন অতীতের স্মৃতি। তিনি বলেন, বাগানে আমার পরিবার আছে। কিন্তু সেখানে কোনো কাজ নেই।
গত বছর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতৃত্বকে উত্খাতের পর থেকে পুরো মিয়ানমারেই পর্যটন শিল্পে ধস নামে। মহামারীতে টিকে থাকলেও বাসিন্দারা এখন কোনো আশা দেখছেন না। তাদের মতে, রাজনৈতিক দিক থেকে ভবিষ্যতের চিত্র হতাশাজনক।
ক্ষমতাচ্যুত অং সান সু চিকে রাখা হয়েছে নির্জন কারাগারে। ১৯৯১ সালের শান্তিতে নোবেল পাওয়া এ নেত্রীর বিরুদ্ধে ২০২০ সালের নির্বাচনে জালিয়াতিসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়। সব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ ১৯০ বছরের দণ্ড হতে পারে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সু চির মুখ বন্ধ রাখতে এ লোক দেখানো বিচার। ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও সশস্ত্র প্রতিরোধে অন্তত ১ হাজার ৯০০ মানুষ নিহত হয়েছে এবং ১৪ হাজারের বেশি গ্রেফতার হয়েছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রায় ৪২ হাজার ৩১৫ জন বিদেশী মিয়ানমারে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডের নাগরিক, মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তাদের সফর। অন্যদিকে মহামারীর আগে ২০১৯ সালে ৪৩ লাখ বিদেশী পর্যটক মিয়ানমার ভ্রমণ করেছিলেন। অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকার নাগরিকদের মিয়ানমার ভ্রমণে সতর্ক করছে। যেমন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ এবং উন্নয়ন অফিস ইয়াঙ্গুন ছাড়া মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দেয়।
পেইং পেইং থ একটি সফল ট্যুর কোম্পানির মালিক ছিলেন। তার গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিল ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের। তারা প্রায়ই বাগানে বেড়াতে চাইতেন। কিন্তু পেইং তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, এখনকার পরিস্থিতিতে পর্যটকরা মিয়ানমারে ফিরে এলেও তাদের ঘুরে দেখাতে তিনি ভয়ই পাবেন।
পরিচয়/সোহেল