আন্তর্জাতিক বাজারে গেল জুলাইয়ে শুধু জ্বালানি তেল নয়, বেশিরভাগ পণ্যেরই দাম কমেছে। আগের মাস জুনের চেয়ে জুলাইয়ে জ্বালানি, কৃষি, খাদ্য, শিল্পের কাঁচামাল, ধাতব পণ্যসহ প্রায় সব খাতের গড়মূল্য কম ছিল। পণ্যমূল্যের ওপর বিশ্বব্যাংকের মাসভিত্তিক প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে এক বছর আগের তুলনায় বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য এখনও অনেক বেশি। এ কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখনও উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি বহাল। এক বছর আগে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল টনপ্রতি গড়ে ৭৩ ডলার। চালের দাম ছিল ৪০০ ডলারের নিচে। সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ ডলারের কিছুটা বেশি।
খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বব্যাংকেরই আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯০ শতাংশের বেশি দেশে এখন উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি রয়েছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের ক্ষেত্রে এ হার ৯৩ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতির কারণে লাখ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
পণ্যমূল্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে আগের মাসের চেয়ে জ্বালানির দাম গড়ে কমেছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমেছে ১০ শতাংশ। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম জুনে ছিল ব্যারেলপ্রতি গড়ে ১২০ ডলার। জুলাইয়ে তা ১০৯ ডলারে নামে। উল্লেখ্য, এই আগস্টে তা আরও কমে ৯৫ ডলারের নিচে নেমেছে। অবশ্য প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলএনজির দাম গত মাসে বেড়েছে।
খাদ্যপণ্যের মধ্যে ভোজ্যতেলের দাম বেশ কমেছে। জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ১২ শতাংশ। আর পাম অয়েলের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ। পাম অয়েল জুনে যেখানে প্রতি টন গড়ে ১ হাজার ৫০১ ডলারে বিক্রি হয়েছে, জুলাইয়ে তা কমে ১ হাজার ৫৭ ডলার হয়েছে। সয়াবিন তেল ১ হাজার ৭৫২ থেকে নেমেছে ১ হাজার ৫৩৩ ডলারে।
ভোজ্যতেল রিফাইনারি কোম্পানিগুলো দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম সম্প্রতি ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। ট্যারিফ কমিশন তা পর্যালোচনা করছে। বিশ্ববাজারে দাম কমার পর এমন প্রস্তাব কেন- জানতে চাইলে দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা সমকালকে জানান, জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কিছুটা কমেছে।
সেই তেল দেশের বাজারে আসবে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে। তাঁরা কিছুদিন আগে বাজারে দাম কমিয়েছিলেন। সম্প্রতি ডলারের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এবং একই সঙ্গে দেশে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্যবৃদ্ধিতে তাঁদের পরিবহন খরচসহ অন্য ব্যয় বেড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন তাঁরা।
আরেকটি ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ছয় মাস আগে বিলম্বিত পরিশোধের যেসব এলসি ৮৬ টাকা ডলারে খোলা হয়েছে, এখন পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংক ১১০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু পণ্যে নিম্নমুখী প্রবণতা রয়েছে। তবে আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে কোনো কোনোটির দাম যে বাড়বে না, সেটার নিশ্চয়তা নেই। আবার যে পণ্য সেপ্টেম্বরে আমদানি হবে, তখন ডলারের দাম কত হবে- তাও অনিশ্চিত। মোটকথা, অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে আসার মূল কারণ হলো, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাস। অবশ্য মন্দা হলে তখন নতুন সংকট তৈরি হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে যাওয়া বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়ের বিবেচনায় স্বস্তির খবর। তবে ডলারের দর যদি বাড়তে থাকে এবং স্থিতিশীল না হয়, তাহলে দেশের বাজারে এর সুফল তেমন পাওয়া যাবে না।
অবশ্য পণ্যের দর বৃদ্ধিজনিত ব্যয়ের চাপ কমতে থাকলে ডলারের দাম কমার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হবে। আরেকটি প্রশ্ন হলো, বিশ্ববাজারের এ পরিস্থিতি টেকসই হবে কিনা। তাঁর মতে, ফিউচার্স মার্কেটের (ভবিষ্যতে মূল্য পরিশোধের জন্য এখন চুক্তি) মূল্য পরিস্থিতিও কমতির দিকে। যেমন- ফিউচার্স মার্কেটে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বর্তমানের চেয়ে ৮ শতাংশ কম। গ্যাসের দাম ৪২ শতাংশ কম। ফলে পণ্যমূল্য কমে যাওয়ার বিষয়ে আশা বেড়েছে।
ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, বিশ্ববাজারের এখনকার নিম্নমুখী প্রবণতার মূল কারণ মন্দার পূর্বাভাস। দেশে দেশে মূল্যস্ম্ফীতি বেড়েছে। এর ফলে ভোগের চাহিদা কমে যাচ্ছে। মন্দা হলে তখন বাংলাদেশের রপ্তানি খাত নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হবে। অবশ্য খুব বড় মন্দা হবে বলে তিনি মনে করছেন না। তাঁর মতে, মন্দা স্বল্পমেয়াদি হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
অন্য পণ্যের দাম :বিশ্ববাজারে আগের মাসের তুলনায় চিনির দাম কমেছে ৪ শতাংশ। চালের দাম কমেছে ৬ শতাংশ। ইউরিয়া সারের দাম কমেছে ১৩ শতাংশ। তুলার দাম কমেছে ১৫ শতাংশ। জুলাইয়ে সার্বিকভাবে কৃষিপণ্যের দাম কমেছে ৭ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামালে গড় দাম কমেছে ৬ শতাংশের মতো। বিভিন্ন ধরনের ধাতব পণ্য, যেমন- নিকেল, কপার, আয়রনের দাম কমেছে ১৭ থেকে ১৯ শতাংশ। স্বর্ণসহ মূল্যবান ধাতব পণ্যের দাম কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ।
খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ :এদিকে, বিশ্বব্যাংকের ‘ফুড সিকিউরিটি আপডেট’ নামে গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ খাদ্যমূল্যের কারণে লাখ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যে পতিত হয়েছে। বিশ্বে ক্ষুধা ও অপুষ্টি বেড়েছে। খাদ্যের দাম বাড়ার প্রভাব নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের ওপর পড়েছে বেশি। কেননা এসব দেশের বেশিরভাগ মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ খাদ্যের পেছনে খরচ করতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক দেশ তাদের খাদ্য-বাণিজ্য সম্পর্কিত নীতিতে পরিবর্তন এনেছে। গত ১১ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ২৩ দেশ ৩৩টি খাদ্যপণ্য রপ্তানি বন্ধ করেছে। অন্তত সাত দেশ ১১টি পণ্যের রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এসব নীতি বিশ্বে বর্তমান খাদ্য সংকটের অন্যতম কারণ। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) গত জুন নাগাদ বিশ্বের ৮২ দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৩৪ কোটি ৫০ লাখে দাঁড়িয়েছে। সূএ : সমকাল
পরিচয়/এমউএ