গত কয়েক বছর ধরে বিএনপি-জামায়াতের মধুর সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, হচ্ছে বলে আলোচনা ও গুঞ্জন শোনা গেলেও প্রকাশ্যে মুখ খোলেনি কোনো পক্ষ। তবে দীর্ঘ টানাপড়েনের পর এবার প্রকাশ্যে দুই দলের মধ্যকার ‘গাঁটছাড়া ছিন্ন’ হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করলেন স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তবে জোটে না থাকলেও জাতীয় স্বার্থে যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে তাদের দল থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। যদিও এবারো এ বিষয়ে দুই দলের কারো পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে জামায়াতের একটি সূত্র বলছে, বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের ইতি ঘটছে উভয় দলের মধ্যে একটি গোপন ও অদৃশ্য সমঝোতার মধ্য দিয়ে।
জামায়াত সূত্র জানায়, যেহেতু যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে জামায়াত দেশে-বিদেশে পুরো কোণঠাসা অবস্থায় আছে। দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে জামায়াতের অবস্থান শুধুমাত্র বিবৃতি আর ভোরবেলায় বিচ্ছিন্ন কিছু মিছিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করার কারণে দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক শক্তিগুলো বিএনপিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে সম্প্রতি বিএনপি যে বৈঠক করেছে, সেখানেও জামায়াতকে নিয়ে বিভিন্ন দল আপত্তি তুলেছে। এসব কিছু বিবেচনায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে একটি অঘোষিত সমঝোতা হয়েছে যুগপৎ আন্দোলনের।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে যেভাবে এই দুই দল যুগপৎ আন্দোলন করেছিল এবং সেই নির্বাচনে একটা অঘোষিত ও অদৃশ্য সমঝোতা ছিল তাদের মধ্যে, সেভাবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এগুচ্ছে দল দুটি। সমঝোতা অনুযায়ী, যুগপৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি সরকার পতনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং একটি অবাধ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হয়, সে ক্ষেত্রে বিএনপি হয়তো জামায়াতের জন্য আগামী নির্বাচনে কয়েকটি আসন ছেড়ে দেবে, সেই আসনগুলোতে নামকাওয়াস্তে প্রার্থী রেখে। বিষয়টি জামায়াত আমিরের বক্তব্যেও স্পষ্ট। বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারাও। গতকাল দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি আসলে লোক দেখানো। এটা তাদের একটি গোপন কৌশল মাত্র। এরা একে-অপরকে কখনো ছাড়বে না।
জানা যায়, গত শনিবার কুমিল্লার রুকনদের উদ্দেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন জামায়াত আমির। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিও বক্তব্যে জোট ত্যাগের পেছনে পুরো দায় বিএনপিকে দিয়েছেন শফিকুর রহমান। তার দাবি, এই জোটকে অকার্যকর করে রেখেছিল প্রধান দল বিএনপি। বারবার দেনদরবার করেও তাদের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়া যায়নি। সে সঙ্গে বিএনপি শরিয়া আইনে বিশ্বাস করে না বলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্যে হতাশ হওয়ার কথা বলেন জামায়াতের এই শীর্ষ নেতা। প্রশ্ন তোলেন বিএনপির ক্ষমতায় থাকার শেষ দিন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের প্রসঙ্গও। সে দিনই এই জোট কার্যত অকার্যকর হয়ে গেছে বলেও মনে করেন তিনি। বক্তব্যে তিনি জানান, বিএনপির সঙ্গে জোটে না থাকার সিদ্ধান্ত দলটির সঙ্গে আলোচনা করেই নেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও সিদ্ধান্ত হয়, জোটে না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে তাদের দল।
এদিকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে বিএনপির নেতারা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির মধ্যে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার দাবি উঠছিল। বছরখানেক আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ধারাবাহিক বৈঠকে অধিকাংশ সদস্যও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার বিষয়ে মতামত দেন। কিন্তু পরে নানা কারণে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। তবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য জোট ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে কিছু স্বীকার করতে চাননি। আবার তিনি অস্বীকার করেছেন, এমনও নয়। বলেছেন, সময় এলে সবকিছু বলা যাবে। এছাড়া জামায়াতের মুখপাত্র ও প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দের বক্তব্যও প্রায় একই। তার দাবি, তাদের আমিরের বক্তব্য আনুষ্ঠানিক নয়। আনুষ্ঠানিক বক্তব্য বিজ্ঞপ্তি আকারেই আসবে। তখন সবাই জানতে পারবে। তাহলে জামায়াতের আমিরের বক্তব্য কি তার ব্যক্তিগত, জানতে চাইলে তিনি বলেন, জোট ছাড়তে হলেও তো দলের সভা বা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হয়। কিন্তু দলের মধ্যে এ ধরনের কোনো সভা বা আলোচনা হয়নি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, তারা (জামায়াত) তো বলেছে, আমাদের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে এবং ঐকমত্য পোষণ করেছে। এখানে আর কি বলার আছে। জামায়াত জোট ছাড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে জানিয়েছে কিনা, জানতে চাইলে টুকু বলেন, এখানে আর আনুষ্ঠানিকতার কি আছে। তাদের (জামায়াত) যা বলার বলে তো দিয়েছে। ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, আমি জামায়াতের আমিরের বক্তব্য শুনিনি। জামায়াতের বিএনপি জোট ছাড়ার অগ্রগতি সম্পর্কেও আমি কিছু জানি না। তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্যও করতে চাই না।
গত শনিবারের সেই ভার্চুয়াল বক্তব্যে জামায়াত আমির শফিকুর রহমান বলেন, আমরা এতদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। আপনারা শুনে হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? হ্যাঁ হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই জোট দেশের জন্য উপকারী একটা জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এই জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়েছে। তারপর সেটা আর ফিরে আসেনি। তিনি আরো বলেন, আমরা বহু চিন্তা করেছি, বাংলাদেশের জন্য এই জোটে আর উপকারী কিছু নেই। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছে, বিশেষ করে প্রধান দল, তাদের এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নেই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শফিকুর রহমান বলেন, এরকম একটা জোটের সঙ্গে যদি কেয়ামত পর্যন্ত থাকি, আর যদি কর্মসূচি না থাকে…আর কোনো অ্যালায়েন্স আপনারা করবেন না, বাস্তবতাও নেই, পারবেনও না। তবে বিএনপি ও জামায়াত আলাদা থাকলেও যোগাযোগ থাকবে জানিয়ে তিনি বলেছেন, বিএনপি যে তাদের দাবিতে বিভিন্ন দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের চেষ্টা করছে, তাতে জামায়াতের সায় থাকবে। জামায়াত আমির বলেন, এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথ চলা। তবে হ্যাঁ জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করব ইনশাআল্লাহ। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব। যদি আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করেন তাহলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে। অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দোয়া করেন, এসব ত্যাগ যেন আল্লাহর দরবারে মঙ্গলজনক হয়। এ ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ পাক যেন আমাদের পবিত্র একটি দেশ দান করে। যে দেশটা কুরআনের আইনে পরিচালিত হবে।
প্রসঙ্গত, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোটের আলোচনা হয়েছিল ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেই। সে সময় জামায়াত ১০০টি আসন চেয়েছিল বিএনপির কাছে। কিন্তু খালেদা জিয়া রাজি না হওয়ায় জোট আর হয়নি। পরে অঘোষিতভাবে গোপন সমঝোতায় ৩৫টি আসনে জামায়াতকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিনিময়ে তারাও দেশের বাকি আসনগুলোতে বিএনপির হয়ে কাজ করেছে। ওই নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। এরপর দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে ‘চারদলীয় জোট’ গঠন করেছিল বিএনপি।
প্রথমে এরশাদ ও পরে আজিজুল হক জোট ছেড়ে দেন। তবে সমালোচনার মধ্যেও জামায়াতকে বিএনপি কখনো ছাড়তে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয় নাজিউর রহমান মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। দুই বছর পর যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাতে এই জোটের ভূমিধস জয়ের পেছনে দুই দলের ভোট যোগ হওয়াই ছিল প্রধান কারণ। তবে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবার জামায়াত সঙ্গ বিএনপির জন্য নেতিবাচক হিসেবেই ধরা দেয়। ওই নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বড় হয়ে ওঠার পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ভরাডুবি হয়। স্বাধীনতাবিরোধী দলটিকে সঙ্গী করে ভোটে নেমে দীর্ঘদিনের শক্তিশালী অবস্থানেও বড় ব্যবধানে হেরে যায় বিএনপি।
ওই নির্বাচনের পর বিএনপির পক্ষ থেকে ১০টি কমিটি গঠন করা হয় বিপর্যয়ের কারণ পর্যালোচনার জন্য। এর মধ্যে ৯টি কমিটিই জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতাকে দায়ী করে- যা ছিল বিএনপির তৃণমূল নেতাদের অভিমত। তৃণমূল নেতাদের দাবি আমলে না নিয়ে জামায়াতকে রেখে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নতুন আরো কয়েকটি দলের সংযুক্তির মাধ্যমে চারদলীয় জোটের কলেবর বেড়ে দাঁড়ায় ২০ দলীয় জোটে। তবে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে এবং নির্বাচনের পর সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলনে জামায়াতকে নিয়েই যোগ দেয় বিএনপি। আর ব্যাপক সহিংসতার পর বিএনপি নেতারা নানাভাবে জামায়াতকে দায় দেন। ওই নির্বাচনের পর একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট কৌশলগত।
সময় এলেই তিনি জামায়াতকে ত্যাগ করবেন। এসব ঘটনায় আবার জামায়াত মনঃক্ষুণ্ন হয় বিএনপির প্রতি। যদিও তাদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য আসেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতাদের বিচারের সময় বিএনপির কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতাও পায়নি জামায়াত। এ নিয়েও খেদ আছে দলের নেতাদের মধ্যে। বিএনপি ২০-দলীয় জোটের পাশাপাশি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরো একটি জোট গঠন করে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে। এর মধ্যে বিএনপির জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গ নানা সময়ই এসেছে। সবশেষ গত বছরের শুরুতে বিএনপি এই জোট ত্যাগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে আর গণমাধ্যমকে কিছু জানায়নি। সূএ : ভোরের কাগজ
পরিচয়/এমউএ