ঢাকা : করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ বেসরকারি খাতও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাড়ছে বিনিয়োগের চাহিদা। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহও বাড়ছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে করোনাকালে তলানিতে নেমে যাওয়া অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ সূচক।
সবশেষ আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর আগের মাস জুলাইয়ে যা ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এর আগে গত জুন শেষে যা ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণপ্রবাহ বেড়েছে, এটা ভালো খবর। তবে বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ার কথা। অর্থাৎ প্রকৃত বিনিয়োগ কতটা বাড়ছে, তাও দেখতে হবে।
এই প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কয়েক মাস ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তাতে এর অবদান রয়েছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পে ব্যাংকগুলো বেশি পরিমাণে ঋণ দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে, এটা ভালো।
জানা গেছে, মূলত আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ঋণ চাহিদা বেড়েছে। তবে আলোচ্য সময়ে নতুন করে কিছু বিনিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে এই ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। যদিও ডলার সংকট কাটাতে গত জুলাই বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে ঋণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অধিকাংশ পণ্যের দর বেড়েছে। যে কারণে এখন সব পর্যায়ে খরচ বেড়েছে। এ সময়ে নতুন করে অনেকে বিনিয়োগও করছেন। এসব কারণে গত এপ্রিলে এক নির্দেশনার মাধ্যমে চলতি মূলধন খাতে বিদ্যমান ঋণসীমা বাড়ানোর সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য এ নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য আমদানি ব্যয় কমাতে গত জুলাইতে কিছু পণ্য আমদানিতে ৭৫ থেকে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণ এবং এসব পণ্যে ঋণ দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এর পরও ঋণ বেড়ে জুলাইয়ে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এর অর্থ হলো ২০২১ সালের আগস্ট মাসের তুলনায় চলতি বছরের আগস্টে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংকিং খাত থেকে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছেন। আগের মাস জুলাইয়ে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
আলোচ্য সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতে যা ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল। মূলত সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা বিশ্লেষণ করে মুদ্রানীতিতে প্রাক্কলন কিছুটা কমানো হয়। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রাক্কলনের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাম্প্রতিক কয়েক বছর বিনিয়োগ চাহিদা কম রয়েছে। সাধারণভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে থাকলেও ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো তা নেমে আসে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর ব্যাপক কমে ২০২০ সালের মে শেষে প্রবৃদ্ধি নামে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে। তবে পরের মাস জুন থেকে একটু করে বাড়তে থাকে।
প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, ২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে নেমে আসে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। মে মাসে তা আরও কমে নেমে যায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে।
২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে নেমে আসে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। মে মাসে তা আরও কমে নেমে যায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে।
তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে উঠে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। তারপর থেকে ঋণপ্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্টে এ সূচক ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ।
২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ফেব্রুয়ারিতে তা কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। এর পর মার্চে আবার বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে দাঁড়ায়। এর পরের মাস এপ্রিলে হয় ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। মে মাসে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
পরিচয়/টিএ