নিউইয়র্ক     রবিবার, ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ৩ বাধা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২২ | ০১:০৫ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২২ | ০১:০৬ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ৩ বাধা

ঢাকা : বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে ৩টি বাধা রয়েছে। এগুলোর ব্যাপক সংস্কার না হলে ভবিষ্যতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী ধারায় চলে যাবে। বাধাগুলোা হলো- শক্তিশালী বাণিজ্য প্রতিযোগিতার অভাব, একটি দুর্বল ও অরক্ষিত আর্থিক খাত এবং ভারসাম্যহীন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ। যদি এই ৩টি প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করা যায়, তাহলে উন্নয়ন বৃদ্ধি পাবে এবং প্রবৃদ্ধি আরও টেকসই হবে। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির হারকে ত্বরান্বিত করতে একটি শক্তিশালী সংস্কার এজেন্ডা প্রয়োজন বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বেশকিছু সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রকাশিত ‘চেঞ্জ অব ফেব্রিক’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের এই পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলো উঠে আসে। এদিকে সম্প্রতি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক সেপ্টেম্বর সংস্করণে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ৬.৬ শতাংশ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), যা জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে এডিবি’র পূর্বাভাস সরকারি হিসাবের তুলনায় অনেক কম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭.২৫ শতাংশে। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

এ ছাড়া বক্তব্য দেন সানেম নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান, এসবিকে টেক ভেঞ্চারস ও এসবিকে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া বশীর কবির। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নিয়ে ‘চেঞ্জ অব ফেব্রিক’ প্রতিবেদনটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংক মুখ্য অর্থনীতিবিদ নোরা দিহেল ও মুখ্য অর্থনীতিবিদের পরামর্শক জাহিদ হোসেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল দেশের একটি। কিন্তু এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই। তবে, বিশ্বব্যাংক বলেছে, সংস্কার না হলে ২০৩৫ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে। আর মোটামুটি ধরনের সংস্কার হলে ৫.৯ শতাংশ এবং ভালো রকম সংস্কার হলে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। সংস্কার না হলে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির গতিও কমে যাবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। কারণ অর্থনৈতিক উচ্ছ্বাস কখনই স্থায়ী প্রবণ নয়। বিশ্বের শীর্ষ প্রবৃদ্ধির দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধির কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বন্ধু হিসেবে বিশ্বব্যাংক আমাদের বেশকিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে। আমরা এই প্রতিবেদনের প্রস্তাবগুলো দেখবো; তারপর সেখান থেকে পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা নেবো।

বিশেষ করে তারা কয়েকটি কথা বলেছে, যেমন আমরা কাপড়ের উপর নির্ভরশীল, ব্যাংকিং সেক্টরে আমাদের কিছু সমস্যা আছে। তবে আমাদের একটা লেভেল আছে এবং আমরা আরও উন্নতি করতে চাই। তবে প্রধানমন্ত্রী বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং এর ফল আমরা হাতে হাতে পেয়েছি। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, খাদ্য ঘাটতি কমেছে, প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ গেছে, স্বাক্ষরতা বেড়েছে। এগুলো কি চিন্তা করার মতো বিষয় নয়? সুতরাং যেসব বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, আমরা তা করছি এবং চালিয়ে যাবো। জোরকদমে হাঁটতে পারবো না। তবে সামনে এগিয়ে যাবো।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি সবসময় উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকে। খুব কম দেশই দীর্ঘ সময়ের জন্য উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। শীর্ষ দশে থাকা দেশগুলোর মাত্র এক-তৃতীয়াংশই পরবর্তী দশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে। গত এক দশকে (২০১০-১৯) যেসব দেশ শীর্ষ ১০-এ ছিল, সেসব দেশ আগের দশকে শীর্ষ ১০-এ ছিল না।

এ ছাড়া বাংলাদেশের শুল্ক হার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি, এ কারণে বাণিজ্য সক্ষমতা কমছে। প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বিশ্বব্যাংক বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। যেমন; রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা।

এ ছাড়া বাংলাদেশের শুল্ক-করহার অন্য দেশের তুলনায় বেশি, যা বাণিজ্যে সক্ষমতা কমাচ্ছে, তাই করহার যৌক্তিক করা। রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক-অশুল্ক বাধা কমিয়ে আনা, তৈরি পোশাক খাতের বাইরে রপ্তানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, খেলাপি ঋণ কমানো, বেসরকারি ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি, এলডিসি উত্তরণের পর টিকে থাকতে বাণিজ্য সক্ষমতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন পরামর্শ উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। ব্যাংকিং খাত নিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ব্যাংকখাত। কিন্তু দেশের আর্থিক খাত অতটা গভীর নয়। গত ৪ দশকে আর্থিক খাতের উন্নতি হলেও এখনো তা পর্যাপ্ত নয়।

অন্যদিকে আধুনিক নগরায়ণ বাংলাদেশের পরবর্তী ধাপের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তাই ভারসাম্যপূর্ণ আধুনিক নগরায়ণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এই বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন খাতে সমস্যা আছে। নানা কারণে এই খাতগুলোয় অনেক ব্যর্থতা আছে। এসব খাতের সংস্কার করতে হবে। অবশ্যই আমরা ভালো সংস্কার করবো, জনগণ সংস্কার চায়, পুরো সংস্কার না পারলেও কিছুটা করতে পারবো।

সংস্কারের সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা বলেছে। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক কিছু সমস্যা আছে, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। সামনে রাজনৈতিক সংঘাত নয়, অনিশ্চয়তা আছে। রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। তবে আশা করি, ঝড় আসবে না। কেন না, ঝড় কারও জন্যই মঙ্গল হবে না।

রাজনীতিবিদদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের আলোচনার পথে আসতে হবে। সভ্যতা-ভব্যতার পথে আসতে হবে।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, লাঠিসোটা দিয়ে দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। এগুলোর জন্য কাজ করতে হবে, বসে আলোচনা করতে হবে। আমরা একটি বিশ্বমানের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে চাই এবং সেই বিবেচনায় আমাদের বিশ্বমানের আচরণে গড়ে উঠতে হবে। আমি বিনয়ের সঙ্গে সব মহলের রাজনীতিকদের বলবো-আসুন, আলোচনা করি। ড্যান ড্যান চ্যান বলেন, প্রতিবেদনে ৩টিতে শক্তিশালী নীতি সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে বাণিজ্য প্রতিযোগিতার ক্ষয়রোধ করা, আর্থিক খাতে দুর্বলতা মোকাবিলা করা এবং সুশৃঙ্খল নগরায়ণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের রূপকল্প অর্জনের জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী এবং রূপান্তরমূলক নীতি পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মত দেন চ্যান।

নোরা দিহেল বলেন, সফল নগরায়ণের অর্থ হবে ছোট এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আকৃষ্ট করা। মাঝারি আকারের শহরের জন্য পরবর্তী স্তরের শহরগুলোকে আনুষ্ঠানিক সংস্থা এবং দক্ষ কর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করবে। এজন্য দ্রুত ব্রডব্যান্ড গতি, মৌলিক পরিষেবাগুলোতে আরও ভালো সুবিধা এবং সহজ আন্তঃনগর পরিবহন সংযোগ চালু করতে হবে।

সার্বিক বিষয়ে পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্বব্যাংকের কথার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমাদের প্রথম প্রজন্মের সংস্কার করা হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের সংস্কার করতে হবে। কিন্তু, আমরা এখনো দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার শুরু করিনি। ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে।- মানবজমিন

পরিচয়/টিএ

শেয়ার করুন