প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় সফরে আগামী ৫ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লি যাচ্ছেন। গত বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর করেছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
প্রায় তিন বছর বিরতির পর শেখ হাসিনার এবারের পূর্ণ দ্বিপক্ষীয় ভারত সফরটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন মোড় নিতে পারে। এবারের সফরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বোঝাপড়া, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি, যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহে সংকট ব্যাপক গুরুত্ব পাবে। একইসাথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সফরটি বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে। সফরের খুঁটিনাটি নিয়ে সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র ভবন এবং রমনার রাষ্ট্রাচার প্রধানের দপ্তরে প্রায় প্রতিদিনই বৈঠক হচ্ছে।
এদিকে ভারত সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের মন্তব্যে অস্বস্তিতে পরেছে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল। তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা সাম্প্রতিক দু’টি বক্তব্যকে বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। একটি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার সেটি করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছেন মর্মে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য। দ্বিতীয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য দেওয়ার একদিন পর ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী এক অনুষ্ঠানে বলেন, ভারত সবসময় বাংলাদেশের পাশে ছিল, আছে ও থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে এ দু’টি বক্তব্য বিশেষ বার্তাবহন করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের বেশ প্রভাব রয়েছে। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের অবস্থা বেশ জটিল। চীন এখনো পাকিস্তানের পাশে, পাকিস্তান আফগানিস্তানের পাশে, রাশিয়া তালেবান সরকারের পাশে। এদিকে চীনের সাথে শ্রীলংকা ও মিয়ানমারের খুব ভালো সম্পর্ক। তাহলে এই অবস্থায় ভারতের অবস্থানটা কী হবে এই উপমহাদেশে? এই মুহূর্তে ভারতের জন্য পরিস্থিতিটা কিন্তু বেশ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সাথেও চীনের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যা ভারতের জন্য বেশ চিন্তার বিষয়। তাই নানা হিসেবে-নিকেষ চলছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে।
এমন অবস্থায় প্রতিবেশী দুই বন্ধু রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যকার মুখোমুখি বৈঠকে রাজনৈতিক সম্পর্কের ‘ভুল বোঝাবুঝি’ নিরসনের চেষ্টা থাকবে। অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। এছাড়া বাংলাদেশের আগামীদিনের নেতৃত্ব নিয়ে ঢাকায় যে জল্পনা-কল্পনা চলছে তা আলোচনায় থাকতে পারে। ঢাকার কর্মকর্তারা হাই প্রোফাইল এই সফরের স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় এ নিয়ে এখনই মুখ খুলতে নারাজ।
তারা বলছেন, সফরের আলোচ্যসূচিতে প্রতিনিয়ত সংযোজন-বিয়োজন ঘটছে। শেষ সময়ে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং হবে, সে পর্যন্ত অপেক্ষার কথা বলছেন তারা। তবে একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে তাতে প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের আশা কম। সেই আভাস পাওয়া গেছে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাতেও। তিনি জানান, পশ্চিমবঙ্গের সাথে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছে দিল্লি।
এদিকে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের প্রস্তুতির মুহূর্তে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র স্বপ্রণোদিত ঢাকা সফর, ঢাকার সাথে বেইজিংয়ের যোগাযোগে তৎপরতা বেড়ে যাওয়া, তথা বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে দিল্লির ডেটলাইনে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বিশ্লেষণধর্মী বেশকিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে ঢাকার সাথে দিল্লির প্রতিরক্ষা চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতির কথাও জানাচ্ছে দিল্লির সংবাদমাধ্যম।
কিন্তু ঢাকার প্রতিনিধিরা এ নিয়ে কিছু খোলাসা করছেন না। দায়িত্বশীল সূত্রের বরাতে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের অনলাইনে একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় বোঝাপড়া হবে। দুই দেশের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সইয়ের ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। বলা হয়েছে- ওই চুক্তির খসড়া ইতোমধ্যে প্রস্তুত ও বিনিময় হয়েছে। সরকারপ্রধানের আসন্ন সফরে বঙ্গোপসাগরের সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি যৌথ উৎপাদনের বিষয়টি পাকাপোক্ত করবে ঢাকা ও নয়াদিল্লি।
আগামী বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগে এটিই হবে শেখ হাসিনার শেষ ভারত সফর। সঙ্গত কারণে এই সফরের দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে দিল্লি। এই সফরকে ফলপ্রসূ করে তুলতে ভারত ও বাংলাদেশ- দুইপক্ষেই কূটনৈতিক তৎপরতা রয়েছে তুঙ্গে। আসন্ন সফরে শেখ হাসিনা দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলে উঠবেন। সফরের দ্বিতীয় দিন ৬ সেপ্টেম্বর হলো শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের মূল ‘বিজনেস ডে’ বা মূল কার্যদিবস। সেদিন সকালে রাজঘাটে গান্ধী সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন ও রাষ্ট্রপতি ভবনে গার্ড অব অনারের মধ্য দিয়ে তার আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা শেষে শুরু হবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলো।
প্রতিনিধিদল পর্যায়ের বৈঠকের পাশাপাশি দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠকও সেদিনই অনুষ্ঠিত হবে। দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দিনভর নানা বৈঠক শেষে শেখ হাসিনা ও মোদির উপস্থিতিতে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র জারি করা হবে বলে ঠিক হয়েছে। ভারতে সিআইআই বা ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের মতো প্রধান বণিক সভাগুলোর প্ল্যাটফর্মে শেখ হাসিনা পরেরদিন সকালে (৭ সেপ্টেম্বর) ভাষণ দেবেন। ওইদিন বিকেলেই তিনি পাড়ি দেবেন রাজস্থানের আজমীর শরীফ দরগায়। এই মাজার জিয়ারত করেই তিনি রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরের বিমানবন্দর থেকেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন।
দুই বন্দরের ব্যবহার চলতি বছর
২০১৯ সালে বাংলাদেশের দুই সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা ব্যবহার করে ভারতের ব্যবসায়ীদের পণ্য আনা-নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর পরীক্ষামূলকভাবে একবার পণ্য পরিবহনও করা হয়। তবে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও বাণিজ্যিকভাবে দুই বন্দর ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখেনি। এ প্রসাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চায়। এজন্য দুই বন্দরের চারটি রুটে চারটি পরীক্ষামূলক চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে।
জ্বালানি সহযোগিতা
জ্বালানি খাতে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য বিশেষ করে জলবিদ্যুৎ খাতের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান (বিবিআইএন) বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচনা করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, গত এপ্রিলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকা সফরের সময় জ্বালানি খাতে দিল্লির সমর্থনের বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে বিবিআইএন কাঠামোর অধীনে জ্বালানি নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের মধ্যে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে পানিসম্পদ বণ্টন, জ্বালানি, সংযুক্তিসহ সম্ভাব্য অংশীদারত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। এ প্রসাথে মাশফি বিনতে শামস বলেন, ভুটান, ভারত ও নেপালের সাথে দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর জ্বালানি সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হলে সব পক্ষ একমত পোষণ করে। জেসিসির বৈঠকে বাংলাদেশ এ বিষয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করতে আগ্রহী।
তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন সফরে বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না, এটা স্পষ্ট। দুই পক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তারাই একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেছেন, তিস্তা চুক্তির জট এই সফরেই খুলে যাবে- সেটাও আশা করা উচিত হবে না। দিল্লির এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে এটাই শেষবারের মতো তার ভারতে আসা। ফলে ভারত শেখ হাসিনাকে কিছুতেই খালি হাতে ফেরাতে পারবে না। আর পরিস্থিতি যদি সেরকমই হতো, তাহলে কিন্তু এই সফরটাই হতো না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনার এবারের সফরে দু’দেশের মধ্যে ‘সেপা’ (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) নামক বাণিজ্য চুক্তিটি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। শেখ হাসিনা সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজে এই চুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছেন। এখন শুধু এ বিষয়ে ভারতের রাজি হওয়ার অপেক্ষা। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শত শত পণ্যের অবাধ ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের জন্য এটিকে একটি ‘ল্যান্ডমার্ক’ বা যুগান্তকারী সমঝোতা বলে গণ্য করা হচ্ছে।
মমতার সাথে কী দেখা হচ্ছে?
শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজধানীতে এসে তার সাথে দেখা করবেন কিনা, তা নিয়েও এই মুহূর্তে জল্পনা তুঙ্গে। শেখ হাসিনা নিজেও চাইছেন দিল্লিতে তার সাথে মমতার দেখা হোক। গত মাসেই তিনি সরাসরি মমতাকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়েছেন, ‘আমি দিল্লিতে আসছি, আপনিও সেখানে আসুন।’ এই প্রস্তাবে প্রচ্ছন্ন সায় ছিল দিল্লিরও। শেখ হাসিনা এই ‘আমন্ত্রণ’ জানানোর পর কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকেও পশ্চিমবঙ্গকে বার্তা পাঠানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দিল্লিতে আসেন তা খুবই ইতিবাচক একটা সংকেত দেবে।
তিস্তার মতো যেসব অমীমাংসিত বিষয় মমতার বাধায় আটকে আছে বলে ধারণা করা হয়, সেগুলো নিয়ে শেখ হাসিনা ও মমতার মধ্যে সরাসরি ও খোলামেলা কথাবার্তা হোক, এটা দিল্লিও চাইছে। কিন্তু বর্তমানে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে সে সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
পরিচয়/এমউএ