সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপাজয়ী দলের ফুটবলার আঁখি খাতুনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরের পাড়কোলা গ্রামে। তাঁতশ্রমিক আকতার হোসেনের কন্যা তিনি। সোমবার কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। এমন দুর্দান্ত জয়ে গোটা দেশ আনন্দ উল্লাসে ভাসছে।
বাংলাদেশের ফুটবলের অনন্য এ জাগরণ দেখে অন্যান্যদের সাথে শাহজাদপুরের আখিঁও বাহবা পাচ্ছেন। অথচ এ বাহবার পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ ও কষ্টের গল্প। এলাকার যারা অতীতে আখিঁকে টিপ্পনি কাটতেন, এমনকি নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করতেন, তারাই এখন তাকে বাহবা দিচ্ছেন, প্রশংসা করছেন। এমনটাই জানালেন ফুটবলে আখিঁর হাতেখড়ি দেওয়া শিক্ষক পাড়কোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক মোঃ মনসুর রহমান।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নারী ফুটবল খেলা প্রবর্তনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শিক্ষক মনসুর রহমান বলেন, ‘আমি শাহজাদপুর বাচামারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হলেও দেড় যুগ আগে পাড়কোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলাম। প্রধান শিক্ষকের সহযোগিতায় দরিদ্র তাঁত শ্রমিক আকতার হোসেনের কন্যা আখিঁ খাতুনকে নিয়ে নারী খেলোয়ারদের দল গঠন করি।
প্রথমে উপজেলা, জেলা, রাজশাহী, অতঃপর ঢাকায়। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি আাঁখিকে। অনুর্ধ ১৫ জাতীয় দলেও খেলার সুযোগ পায় আখিঁ। নারী হয়ে ফুটবল খেলে বলে এক সময় গ্রামবাসী তাকে ভর্ৎসনা করেছে। এজন্য আমাকেও গালমন্দ করতেন গ্রামবাসী, বিশেষ করে যাদের মধ্যে ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি।সেই তারাই এখন আঁখিকে বাহবা দিচ্ছেন, প্রশংসা করছেন। কারণ আঁখি এখন বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের তারকা খেলোয়াড়। গত ডিসেম্বরে ভারতকে হারিয়ে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাল সবুজের দল। আর সে কারণেই নিন্দুকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পাচ্ছে আঁখিরা।’
পাড়কোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আলাউদ্দিন হোসেন বলেন ‘২০১১ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নারী ফুটবল খেলা শুরু হয়। পরের বছর আখিঁকে নিয়ে দল গঠন করেন সহকর্মী মুনসুর রহমান। তিনি নিজেও একজন সাবেক ফুটবলার ছিলেন।’
আখিঁর বাবা আকতার হোসেন বলেন, ‘এলাকার প্রাইমারী স্কুলের মনসুর স্যার এবং ইব্রাহীম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের লাকী ম্যাডাম আখিঁকে প্রচন্ড সহযোগিতা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশপাশি ওই দু’জন শিক্ষকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আখিঁর জন্য আজ আমি গর্বিত ও সম্মানিত। প্রধানমন্ত্রী উপহার হিসেবে ১৫ লাখ দিয়েছেন। সে অর্থ দিয়ে আমি জমি কিনে চাষাবাদ করে সংসার চালাচ্ছি।’
ইব্রাহীম পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক কামরুন নাহার মঙ্গলবার দুপুরে সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলের আজকের জয়ের পেছনে আছে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট। আঁখির উঠে আসা এই টুর্নামেন্ট দিয়েই। ২০১৪ সালে আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তির পর বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলে আঁখি। এরপরে নাম লেখায় বিকেএসপিতে। সেখান থেকে ডাক পায় ২০১৫ সালে তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ দলে। সেখানেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। আখিঁ, পারভীন, জেসমিনসহ ১২ জনকে নিয়ে আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুন নাহার লাকী নারী ফুটবল খোলোয়ারদের একটি দল গঠন করেন। ৮জন বিকেএসপিতে সুযোগ পেলেও অন্যান্যরা ঝড়ে পড়ে। এত দারিদ্রদার মধ্যেও তাঁত শ্রমিক কন্যা আখিঁ দমেনি।’
জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল হাসান হিলটন বলেন, ‘আঁখি সিরাজগঞ্জের সন্তান। আমি মাঠে থেকে পুরো খেলা দেখেছি। রক্ষণভাগের পুরো অংশে আঁখির ব্যাকআপ অসাধারণ। মুহুর্তের ভিতরে ওভারলেকিং ছাড়া লং পাসের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে সবসময় চাপে রেখেছিল। তার এই অসামান্য অবদানে জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমরা আঁখিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।’
জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিদপ্তরের অধীনে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট আঁখির ফুটবলে হাতেখড়ি। এর পরে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে খেলার সুযোগ পায়। এখন জাতীয় দলের হয়ে খেলছে। বর্তমানে আঁখির খেলার মান অসাধারণ। সাফের শিরোপা লড়াইয়ে দেশের হয়ে অবদান রাখায় আমরা আনন্দিত। জেলা প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে আগামীতে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে।’
পরিচয়/সোহেল