বিশ্বের ‘ডার্টি ফুয়েল’ বলে কয়লা থেকে সরে আসছিল বড় বড় দেশ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির অগ্নিমূল্যের মধ্যে আবার কয়লাকে প্রাধান্য দিচ্ছে সেসব দেশ। বিশ্ববাজারে জ্বালানির চড়া দরের এই একই কারণে দেশে মজুত কয়লায় নজর দিতে চায় সরকার। কিন্তু কোনও প্রক্রিয়ায় এটি করা হবে তাই এখন নির্ধারণ করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে দেশের পাঁচটি কয়লা খনির মধ্যে একমাত্র বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। বড়পুকুরিয়ায় মোট (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) মজুত আছে ৩৪৬ দশমিক ৭১ মিলিয়ন টন। এছাড়া অন্য খনিগুলোর মধ্যে ফুলবাড়িতে ৫৭২ মিলিয়ন টন, খালাসপীরে ৫২৩ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন টন, জামালগঞ্জে ১ হাজার ৫৩ দশমিক ৯ মিলিয়ন টন এবং দীঘিপাড়ায় ৬০০ মিলিয়ন টন। মোট মজুত ৩ হাজার ১৩৯ দশমিক ১০ মিলিয়ন টন। কিন্তু এরমধ্যে মাত্র একটি খনি থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে। বড়পুকুরিয়া থেকে এখন প্রতিদিন তিন হাজার মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। যা দিয়ে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫৬০ মেগাওয়াট পূর্ণ ক্ষমতার অর্ধেক ২৫০ মেগাওয়াট সচল রাখা যাচ্ছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, দেশে কয়লার মজুত এবং উত্তোলন পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন খুব শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে দেশের কয়লা খনিগুলোর ওপর ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে জ্বালানি বিভাগ।
প্রসঙ্গত, দেশে এখন একটি মাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র বড়পুকুরিয়া দেশীয় কয়লায় চলছে। কিন্তু এর বাইরেও দেশে দুটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা ১৩২০ ও রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সেগুলোর কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, আগামী বছর আরও দুটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট এবং বাশখালীর ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। সব মিলিয়ে বাশখালী, পায়রা, মাতারবাড়ি ও রামপালে ৫ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা আমদানি করতে হবে। আমদানি করে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে খরচ বেড়ে যাবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান সম্প্রতি দেশের কয়লা উত্তোলনে সরকারের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা সব উৎস থেকে জ্বালানি সংস্থানের চেষ্টা করছি। এজন্য কোন প্রক্রিয়ায় কয়লা উত্তোলন করা যায় তা যাচাই করা হচ্ছে।
আরেকটি বিষয় হলো, যেখানে কয়লা খনিগুলো রয়েছে সেগুলোর ওপরের জমিতে ব্যাপকভাবে ফসল উৎপাদন হয়। এখন এই খনিগুলোর জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলে বিস্তীর্ণ এলাকা দেবে যাবে। সেখানে আর ফসল উৎপাদন সম্ভব হবে না। এজন্য সরকার শুরুতে কয়লা তোলার বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল।
এরমধ্যে বড়পুকুরিয়া থেকে যে কয়লা আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে (সুড়ঙ্গ পথে) তোলা হচ্ছে, তাতে সেখানে বিস্তীর্ণ এলাকা দেবে গেছে। এখন সেখানে একটি ভাসমান সোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
অন্য খনিগুলো উন্নয়ন করলে সেখানেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে ওপেন পিট (উন্মুক্ত পদ্ধতি) করলে পুরো এলাকা খুঁড়ে মাটি সরিয়ে ফেলতে হবে। ফলে সেখানেও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নষ্ট হয়। এসব জমিতে আর কখনও ফসল ফলে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং বা ভূগর্ভস্থ খনি করলে সর্বোচ্চ ৪০ ভাগের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে বেশি কয়লা তুলতে চাইলে ওপেন পিট বা উন্মুক্ত খনি করার কোনও বিকল্প নেই। তবে দেশের কয়লা খনিগুলোর গভীরতা এত বেশি যে ওপরের মাটি সরিয়ে ওপেন পিট করা সহজ কোনও বিষয় না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, সারা বিশ্বে জ্বালানি সংকটের এই সময়ে কয়লার দিকে ঝুঁকছে। আমাদেরও উচিত ওদিকে যাওয়া। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে কয়লা তোলার ক্ষেত্রে আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিংয়ের চেয়ে ওপেন পিট মাইনিং পদ্ধতি ভালো হবে। আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিংয়ের ক্ষেত্রে কৃষি জমি রক্ষা পেলেও পরে দেবে যায়। সেখানে ফসল করা যায় না। কয়লাও কম ওঠে। আর ওপেন পিট মাইনিং হলে কয়লা বেশি উত্তোলন সম্ভব। এক্ষেত্রে এক জায়গায় মাটি কেটে রেখে আরেক জায়গায় রাখা হয়। পরে কয়লা তোলার পর আবার মাইন ভরাট করে ফেলা যায়। শেষ পর্যন্ত বড় জলাধার সৃষ্টি হয়। সেখানে মাছ চাষাবাদ বা অন্য কোনও উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
পরিচয়/সোহেল