নিউইয়র্ক     সোমবার, ১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গরমের তেজ কমলে কমবে লোডশেডিং

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২২ | ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২২ | ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
গরমের তেজ কমলে কমবে লোডশেডিং

বাংলাদেশ ডেস্ক : অফিস শেষে যানজট ঠেলে মারজিয়া আক্তার যখন পুরান ঢাকার বাসায় ফেরেন তখন সাঁঝবেলা। সাড়ে ৭টার দিকে সন্তানদের পড়ার টেবিলে বসাতে না বসাতেই বিদ্যুৎ হাওয়া। লোডশেডিং আর প্রচণ্ড গরমে তাদের পড়াশোনা ওঠে শিকেয়। ঘামে জবজব হয়ে চার্জ লাইটের আলোতে ঘরের অন্য কাজ সারেন মারজিয়া। বিদ্যুৎ আসে রাত পৌনে ৯টায়। রাতের খাবার শেষ করে সন্তানদের নিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার পরই সাড়ে ১১টার দিকে আবার বিদ্যুৎহীন।

গরমের তীব্রতায় ঘুমাতে গিয়ে সবার হাঁসফাঁস অবস্থা। ক্লান্ত শরীরেও হাতপাখার বাতাসে সন্তানদের ঘুম পাড়ান। বিদ্যুৎ আসে রাত দেড়টায়। আবার চলে যায় ভোর ৪টায়। গরমে ফের সবার ঘুম ভাঙে। গত সোমবার রাতে মারজিয়া আক্তারের লোডশেডিংয়ের যাতনার অভিজ্ঞতা ছিল এমনই। দিনভর বিদ্যুতের ভেল্ক্কিবাজির পর রাতেও এমন লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হয়ে এক রকম দুর্বিষহ জীবন পার করছেন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ। ঢাকায় দিন-রাত মিলিয়ে অন্তত চার ঘণ্টা, আর গ্রামে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকছে না। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী সূচি ধরে লোডশেডিং হওয়ার কথা থাকলেও তা আর ঠিক থাকছে না। ছক ভেঙে যখন তখন বিদ্যুৎ যাচ্ছে আর আসছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পর কয়েক বছর সে মাত্রায় লোডশেডিং ছিল না। করোনাপরবর্তী সময়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বে জ্বালানির বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে বেকায়দায় পড়ে সরকার। খরচ সাশ্রয়ে জ্বালানির গ্যাস আমদানি কমিয়ে দেয়। শুরু হয় তেলের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। এতে বিদ্যুৎ খাতে বাড়ে জ্বালানি সংকট। গত এপ্রিল থেকে বাড়ে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। ১৯ জুলাই সরকার ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করে। সেপ্টেম্বরে একটু কমলেও অক্টোবরের শুরু থেকে পরিস্থিতির আবার অবনতি ঘটে। বর্তমান সময়ে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি পার করছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘আশা করেছিলাম, সেপ্টেম্বর থেকে লোডশেডিং কমবে। তা হয়নি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখনও অনুকূলে নেই। দাম বাড়ায় গ্যাস আনা যাচ্ছে না। ডলার সংকট ও পিডিবির কাছে বিল বকেয়া থাকায় কমে গেছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর তেল আমদানি; কমেছে উৎপাদন। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামও কমছে না। দিনে যেসব তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হয়, সেগুলো রাতে বন্ধ রাখা হচ্ছে। শিল্পে বেশি গ্যাস দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। তাই লোডশেডিং বন্ধ করা যায়নি। নভেম্বরের আগে কোনো সুখবর নেই।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম সমকালকে বলেন, ‘জ্বালানি সংকটে বিদ্যুতের উৎপাদন কম হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম না কমলে পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা নেই।’

বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েলের দাম ১০০ ডলারের নিচে থাকলেও পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের দাম আবার বেড়েছে। পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগেও ব্যারেলপ্রতি ডিজেলের দাম ১১০ ডলারে নেমেছিল। তা আবার ১৪০ ডলারের ওপরে উঠেছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে তেলের দাম কমার সম্ভাবনা কম।

লোডশেডিং বাড়ার নেপথ্যে : উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে জুলাইয়ের চেয়ে অক্টোবরে লোডশেডিং পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। জুলাই-আগস্টে গড়ে দৈনিক ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছিল। এখন এর পরিমাণ তিন হাজার মেগাওয়াট পেরিয়ে গেছে। এর মূল কারণ গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২২৫ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিচ্ছে পেট্রোবাংলা।

জুলাইয়ে দিনে গ্যাস সরবরাহ ছিল ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকে পাওয়া যেত ৫৫ কোটি ঘনফুট। কয়েক দিন ধরে এলএনজি থেকে পাওয়া যাচ্ছে ৩৮ কোটি ঘনফুট। এলএনজির কার্গো আসার পরিমাণ কমায় সরবরাহ কমেছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, আগের তিন মাসে পাঁচটি করে এলএনজির কার্গো এলেও অক্টোবরে আসবে মাত্র চারটি।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমেছে। এখানে দুটো ঘটনা ঘটছে। এক, ব্যয় সাশ্রয়ে সরকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কম চালাচ্ছে। দুই, ফার্নেস অয়েল সংকটে বেসরকারি খাতে উৎপাদন কম হচ্ছে। ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বিপ্পার সভাপতি ইমরান করিম বলেন, সরকারের কাছে প্রায় চার মাসের বিদ্যুৎ বিক্রির ১৬ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অর্থ সংকটের কারণে অনেক মালিক ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছেন না। ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে। তিনি জানান, ডলার সংকটের কারণে তেল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মালিকরা এলসি খুলতে পারছেন না। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের খরচ বেড়েছে। পিডিবি আগের দরেই বিল দিচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিদ্যুৎ বিল পান ডলারে। পূর্ব চুক্তি অনুসারে প্রতি মার্কিন ডলার ৮৪ টাকা ধরে তাঁদের বিল পরিশোধ করে পিডিবি। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমায় ব্যবসায়ীরা ডলারপ্রতি টাকার পরিমাণ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। তবে অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও জানায়নি। এ কারণে ব্যবসায়ীরা তেল আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ খাতে এমন ছাড় দিলে অন্য উদ্যোক্তারাও এমন দাবি জানাবে, যা অর্থ খাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে।

উৎপাদন চিত্র : দেশে ১৩৩ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৭১০ মেগাওয়াট। গ্যাসচালিত ৫৭ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। গ্যাস সংকটে ৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কম হচ্ছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত ৫৬ কেন্দ্রের ক্ষমতা ৫ হাজার ৫৪১ মেগাওয়াট। ডিজেলের ১১ কেন্দ্রের ক্ষমতা ১ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্র থেকে দিনে গড় উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪ হাজার মেগাওয়াট। এর বাইরে মেরামত ও সংরক্ষণের কারণে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

তথ্যে গরমিল : পিডিবির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, গত সোমবার দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৯২৩ মেগাওয়াট। তবে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৯০১ মেগাওয়াট। পিডিবির দাবি, সারাদেশে লোডশেডিং হয়েছে ৯৪২ মেগাওয়াট। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর তথ্য বলছে, দেশে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। শুধু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ঘাটতির পরমিাণ ছিল এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর বাইরে আরও চারটি বিতরণ কোম্পানি রয়েছে।

রাজধানীতে চার-পাঁচবার : আগের কয়েক মাসের চেয়ে রাজধানীতের লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে। ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ (ডিপিডিসি) জানিয়েছে, তাদের এলাকায় এখন দিনে চার থেকে পাঁচবার লোডশেডিং হচ্ছে। জুলাই-আগস্টে দিনে দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং করতে হয়েছিল। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান গতকাল সমকালকে জানান, তাঁদের চাহিদার চেয়ে ৪০০-৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন। ফলে বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

গ্রামে যায় আর আসে : নরসিংদী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় থাকা বেলাব উপজেলায় সোমবার রাত ২টা থেকে বিদ্যুৎ যাওয়ার প্রায় ৪ ঘণ্টা পর ভোর ৬টায় আসে। সকাল সাড়ে ৮টায় লোডশেডিং শুরু হয়ে থাকে ১১টা পর্যন্ত। ৭ মিনিট পর ১১টা ৮ মিনিটে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে চালু হয় ১১টা ২৬ মিনিটে। দুপুর ১টা ৩৪ মিনিটে গিয়ে আসে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে লোডশেডিং শুরু হয়ে শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টা ৩৪ মিনিটে। রাত ১০টা ৫০ মিনিটে গিয়ে আসে ১১টা ৫৪ মিনিটে। মঙ্গলবার রাত দেড়টায় বিদ্যুৎ গিয়ে ফিরে আসে রাত আড়াইটায়। মঙ্গলবার ভোর ৫টা ১৪ মিনিটে গিয়ে আসে ৫টা ১৯ মিনিটে। দেশের প্রায় সব উপজেলা ও গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের এমনই ছবি। গ্রামে ১০-১২ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকছেই না।

দক্ষিণের জেলায় কম : সারাদেশের বিরূপ বিদ্যুৎ পরিস্থিতির মধ্যেও ভালো আছে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলো। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকায় এসব এলাকায় কম লোডশেডিং হচ্ছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র, ভারত থেকে আসা বিদ্যুতের কারণে পশ্চিমাঞ্চলের গ্রিডে সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো। এ ছাড়া এ অঞ্চলে দ্বৈত জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি। ফলে গ্যাস সংকট থাকলেও তেলে এসব কেন্দ্র চালানো যাবে। এদিকে পূর্বাঞ্চলের গ্রিডে চাহিদা বেশি। কারণ ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো এলাকাগুলো এই গ্রিডের আওতায়। পূর্বাঞ্চল গ্রিডের আওতায় যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র; এর অধিকাংশ শুধু গ্যাসচালিত। তাই সংকট বেশি।

আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে : সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নভেম্বর থেকে লোডশেডিং কমতে পারে। সংশ্নিষ্টদের মতে, মূলত আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সরকার। গরমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। শীত শুরু হলে এই লোড কমে আসবে। তখন তিন থেকে চার হাজার মেগাওয়াট চাহিদা কমবে। ফলে লোডশেডিং তেমন থাকবে না।

এ ব্যাপারে নসরুল হামিদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, গরমের তীব্রতা না কমলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাপমাত্রা কমার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।
শীতের পর কী : অধ্যাপক ম. তামিম সমকালকে বলেন, শীতে চাহিদা কমলে লোডশেডিং কম হবে। তবে আগামী মার্চে গরম ও সেচ মৌসুমের কারণে চাহিদা ফের বাড়বে। তখন পরিস্থিতি আবার আগের আবস্থায় ফিরবে, যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন না বাড়ে। তিনি বলেন, এ সময়ে যদি রামপাল ও ভারতের আদানি থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সূএ : সমকাল
পরিচয়/সোহেল

শেয়ার করুন